করোনা সংকট মোকাবেলায় অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের প্রচেষ্টা
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
‘আতংক নয়, সচেতনতায় করোনা থেকে মিলবে মুক্তি’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে নেত্রকোনা সদর উপ-পজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠন বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে আসছে। সংগঠনের কিশোরী সদস্যরা এপ্রিল ২০২০ মাস থেকে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা এবং এ ভাইরাস সংক্রমণ রোধে করণীয় সম্পর্কে, বিশেষভাবে গ্রামের জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার বিষয়ে সচেতন করে আসছে। এছাড়াও একান্ত প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে না যাওয়ার জন্য কিশোরীরা গ্রামের সকলকে সচেতন করে আসছে। সংগঠনের উদ্যোগে গড়ে তোলা কিশোরী তথ্য কেন্দ্রে বসেই তারা করোনাকালীন সময়ে সংগঠেেনর করণীয় নির্ধারণ করে সংগঠনের সামর্থ অনুযায়ী বেশকিছু কাজ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চুড়ান্ত করে। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে প্রথমে নিজে সচেতন হওয়া এবং নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের সচেতন করা এবং পরে গ্রামের অন্রান্য জনগোষ্ঠীকে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন উদ্যোগ গ্রহণ করে। বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সংগঠনের সদস্যরা গ্রামের জনগোষ্ঠীর সাথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে আলোচনা ও মাইকিং করে প্রচার করে।
সংগঠনের কিশোরী সদস্য কমা আক্তার সকলকে সবসময় পরিস্কার পরিছন্ন থাকতে, সাবান দিয়ে নিয়ম মাফিক হাত ধৌত করতে, বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করতে, কোন জিনিস ধরলে বা হাতে নেয়ার আগে প্রথমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে পরিস্কার করা বা স্প্রে করে নেয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজার না থাকলে সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়ার পরামর্শ দেয়। এছাড়াও সামাজিক দুরুত্ব বজায় রেখে চলতে, সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত না ধুয়ে মুখ, নাক ও কান স্পর্শ না করা, হাঁচি বা কাঁশি দিলে মূখের সামনে টিস্যু, রুমাল, কাপড় দেয়া বা হাতের কুনুই ভাঁজ করে ব্যবহার করা পরামর্শ দেয়। কমা আক্তার প্রথমে সংগঠনের সদস্যদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে যতটুকু সচেতন থাকা দরকার ততটুকু সচেতন থেকে কাজ করার পরামর্শ দেয়। কমা আক্তার সকলকে ভিটামিনযুক্ত খাবার বেশি বেশি খেতে, বিশেষভাবে লাল জাতীয় শাক্সবজি খাওয়ার জন্য গ্রামের জনগোষ্ঠীকে সচেতন করার জন্য সংগঠনের সকল সদস্যদেরকে পরামর্শ দেয়।
সঙগঠনের কিশোরী সদস্য শিমু আক্তার, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রচুর পরিমাণে শাক্সবজি ও ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দেন। মহামারী করোনা ভাইরাসে আতংকিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, খালি জায়গাগুলোতে বৈচিত্র্যময় শাক্-সবজি ও স্থানীয় জাতের ফরের গাছ রোপণের জন্য সকলকে পরামর্শ দেয়। সংগঠনের সদস্যরা সরকারি সেবাদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগের নম্বর, আইইসিডিআর এর মোবাইল নম্বর, জরুরি স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ফোন নম্বরগুলো গ্রামের জনগোষ্ঠীর নিকট পৌছে দিয়েছে, যাতে তারা করোনা আইরাসের উপসর্গ দেখা গেলেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করে স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে। কিশেরিী সংগঠনের সদস্যরা এলাকার দিন আনে দিন খায় এমন অসহায় পরিবার, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধি ব্যক্তি, যারা অন্যের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল এবং করোনাকালীন পরিস্থিতিতে বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারছেনা, ঘরবন্দী থেকে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে এমন ব্যক্তি পরিবারের দিকে বাড়িয়েছে তাদের ছোট ছোট সাহায্যের হাতগুলো। কিশোরীরা এসব ব্যক্তি ও পরিবারের তালিকা করে স্থানীয় সরকার প্রধান চেয়ারম্যান মহোদয়ের নিকটে জমা দিয়েছে। এছাড়াও তারা নিজেরা চাঁদা তুলে এবং গ্রামের স্বচ্ছল পরিবারগুলোর সহযোগিতায় স্থানীয় যুবকদের নিয়ে করোনাকালীন সংকট মোকাবেলায় গ্রামে ২০০টি অসহায় পরিবারের মধ্যে চাল, ডাল ও আলু দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এছাড়াও গ্রামের ৩০০টি পরিবারের মধ্যে হাত ধোয়ার জন্য সাবান ও মাস্ক দিয়ে সহযোগিতা করেছে। সরকারিভাবে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে গ্রামের ৭ জন অতিদরিদ্র প্রবীণ ব্যক্তিকে নগদ ২৫০০ টাকা করে পেতে সহযোগিতা করেছে কিশোরী সংগঠনটি।
করোনার পরিস্থিতিতে দোকান বন্ধ থাকায় এবং গ্রামে কোন চিকিৎসক না থাকায় গ্রামের গর্ভবতী মায়েরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে করোনা সংক্রমণের আতংকে শহরের হাসপাতালে যেতে সাহস পাচ্ছেনা। ফলে তাদের নিয়মিত শরীর চেকআপের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এমতাবস্থায় অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনটি গ্রামের গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে এসেছে। সংগঠনটি কিশোরী তথ্য কেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ যুব সদস্যদের সহযোগিতায় গ্রামের গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে চলেছে। স্বাস্থ্য সেবার মধ্যে রক্তচাপ ও ওজন পরিমাপা, ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা এবং জরুরী প্রয়োজনে ভ্যানে করে রোগীকে সদর হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে চলেছে। গর্ভবতী একজন মূমূর্ষু মাকে সংগঠনের কিশোরী সদস্য সুমা আক্তার নিজে রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছেন এবং রোগীর সেবায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়াও সংগঠনটি করোনাকালীন সংকটে গ্রামের প্রবীণ ব্যাক্তিদের নিয়মিত ওজন পরিমাপ, রক্তচাপ পরিমাপ, ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক পরামর্শ দিয়েছে সহযোগিতা করেছে।
করোনাকালীন সংকটে ফচিকা গ্রামের অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের এহেন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। সংগঠনের সদস্যরা ছোট হলেও তাদের গৃহীত উদ্যোগগুলোকে ছোট করে দেখা বা অবহেলা করার কোন উপায় নেই। কারণ তারা করোনাকালীন সংকটে যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করেছে সেগুলো কিন্তু অনেক বড়। আমাদের দেশে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে, যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য অনেক কাজ করে থাকে। কিন্তু দেশের এমন বিপদের সময় তারা কিন্তু নিশ্চুপ রয়েছে। শুধু নিশ্চুপ থাকতে পারেনি এই কিশোরী সংগঠনটি। তারা তাদের সামর্থ অনুযায়ী অসহায়দের প্রতিতাদের ছোট ছোট সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আসুন আমরা এই সাহসী কিশোরীদের সেলুট জানাই, করোনাকালীন সংকট মোকাবেলায় আমাদের হাতটাও বাড়িয়ে দিই।