ভেন্না একটি অসাধারণ ভেষজই শুধু নয়, খাদ্য উপাদানও
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পনা ঘাগ্রা
আমাদের প্রাণ আর প্রকৃতি খুবই বৈচিত্র্যময়। আমরা যে গাছকে আগাছা মনে করে পায়ে দলে চলে যাই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও তা মানুষের জরুরি প্রয়োজনে কাজে লাগে। মানুষ তার নিজস্ব চিন্তা আর লোকজ গবেষণার মাধ্যমে তৈরি করেছে এর নানান রকম ব্যবহার। এই সকল গাছেরই রয়েছে বৈচিত্র্যময় নিজস্ব গুণাবলী। প্রয়োজন মতো সঠিক গাছ, লতা, পাতা, ফুল, শিকড় বেছে নিতে জানলেই মানুষ এগুলো থেকে অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারে। যেমন হঠাৎ কেটে গেলে রক্ত পড়া বন্ধ করার জন্য এখন গ্রামগঞ্জে গাঁদা ফুলের পাতা বা দূর্ব্বা ঘাস ছেঁচে লাগিয়ে দেয় মানুষ, একইভাবে সর্দি কাশির জন্য তুলসী ও আদার রসের ব্যবহার, ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য লজ্জাবতী লতা, পেঁয়ারা পাতা, গন্ধতৃণ পাতা প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকে।
মানুষের এই লোকায়ত জ্ঞান একদিনে তৈরি হয়নি এসব উদ্ভিদের গুণগুলো আগেকার মানুষেরা নিজস্ব প্রয়োজনেই জানার ও বুঝার চেষ্টা করেছে এবং সংরক্ষণ করেছে। কারণ আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি তখনও আবিস্কার হয়নি। মানুষ তাই নিজের স্বার্থেই প্রকৃতির সাথে এক সখ্যতা গড়ে তুলেছিল। প্রকৃতিতে এখনও অনেক উদ্ভিদ থাকলেও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যাপক প্রসারের কারণেই বর্তমান প্রজন্মের কাছে ভেষজ চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ অনেক কমে গেছে। কমে গেছে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ।
আজ আমরা এমই একটি ভেষজ উদ্ভিদের কথা বলবো যার নাম ভেন্না। গ্রামাঞ্চলে পথের ধারে বা বাড়ির পাশে জন্মাতে দেখা যায় এই গাছ। বর্ষাকালে বাড়ির আশে পাশে, রাস্তার ধারে, নদী ও খাল বিলের ধারে ভেন্না জন্মাতে শুরু করে। ৫-৬ ফুট পর্যন্ত গাছ লম্বা হলে ফুল ধরতে শুরু করে। ফুলের রঙ সাদা। গাছ একবার টিকে গেলে পর্যায়ক্রমে সারাবছর ধরেই ফুল ও ফল হয়। কিন্তু ভেন্নার ফল পাখি দ্বারা না ছড়ালেও বন্যার পানির মাধ্যমে পাহাড় থেকে এসে বিভিন্ন এলাকায় ছড়ায় বলে জনগোষ্ঠীর ধারণা। একবার কোন জায়গায় এই গাছ জন্মালে এবং ফল ধরলে এর বীজ থেকেই আশেপাশে চারা গজাতে থাকে। এর চারা রোপণ করার প্রয়োজন পড়ে না। এটি সব জায়গায় জন্মে। তবে জলাবদ্ধ এলাকায় বেশিদিন বাঁচেনো। এর পাতা ও ডাল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ডাল বেড়া দেয়া ও সবজির মাঁচা দেয়ার কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। সবচে’ বড় কথা হলো ভেন্না ব্যবহ্নত হয় ভেষজ একটি উপাদান হিসেবে। গ্রাম-গ্রামান্তরে ভেন্নার তেল ঔষধ হিসেবে এবং কি খাবার হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের দিলুরা গ্রামের কৃষাণী সালমা খাতুন (৫০) বলেন, “প্রতি বছর আমার বাড়ির আশেপাশে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভেন্না গাছ জন্মায়। গাছটি আমি সযতেœ সংরক্ষণ করি। কারণ আমি জানি ভেন্নার বীজ দিয়ে তৈল তৈরি করা যায় এবং এই তৈলের রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যবহার।” তিনি আরও বলেন, “ভেন্না দিয়ে তৈল তৈরির পদ্ধতি আমি তার দাদীর কাছ থেকে শিখেছি। এখন আমাকে দেখে শিখছে আমার সন্তান, ছেলের বৌ ও প্রতিবেশীরা। আমি ভেন্নার তেল তার পরিবারের প্রয়োজনেই সংরক্ষণ করি।”
ভেন্নার তেল বানানো প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্থানীয়রা বলেন, প্রথমে পাকা ফল সংগ্রহ করে তা থেকে বীচি বের করে নিতে হয়। সংগৃহিত বীচি প্রথমে সিদ্ধ করে রোদে দিতে হয়। তারপর বীচিগুলো কড়াইয়ে ভেজে পাথরে পিসতে হয়। প াথরে পিসার পর গুড়োগুলো বড় পাতিলে পানিতে জাল দিতে হয়। জাল দিতে দিতেই পানির উপরেই তেলের অংশগুলো বলের মত গোল গোল হয়ে পানিতে ভাসতে থাকে। পানিতে ভাসমান সেই গোলাকার বলগুলো বড় চামচ দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। সেইগুলোই মূলত ভেন্নার তৈল। এই তেলের রং সয়াবিন তৈলের মত। তবে গন্ধটি ভিন্ন। তারা জানায় ১কেজি তৈলের জন্য আড়াই কেজি ভেন্নার বীজের প্রয়োজন হয়।
ভেন্নার তেলের উপকারিতা সম্পর্কে স্থানীয়রা জানান, ভেন্না তৈল দিয়ে তরকারি রান্না করা যায়, পিঠা তৈরি করা যায়। গরম ভাতের সাথে খাওয়া যায়। এটি খাবারের রুচি বাড়ায়। মাথায় দিলে মাথা ঠান্ডা রাখে। শরীরের যেকোন কালো দাগ মিলিয়ে যেতে বিশেষভাবে আগুনে পোড়ার দাগ মিলাতে বিশেষ কার্যকরী। পুকুর, ডোবা, খাল বিলের জলাবদ্ধ আবর্জনাযুক্ত পচা পানিতে নামার পূর্বে এর তৈল শরীরে মেখে নিলে শরীর চুলকায়না এবং জোঁক কামড় দেয়না। এর কাঁচা বীজ কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা সমাধানে বিশেষ কার্যকর। ছোট শিশুদের জ্বরের সময় এর ছাল গলায় ঝুলিয়ে দিলে বমি করা বন্ধ হয়। শিশুদের ঠান্ডা লাগলে তৈল গরম করে বুকে লাগালে ঠান্ডা উপশম হয়। এরকম হাজারো সমস্যার সমাধান হিসেবে এটি ভেষজ ও খাদ্যমান সম্পন্ন একটি উদ্ভিদ।
চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের পুলক কুবি (৫০)বলেন, “মেঘালয় রাজ্যের আসামের মেন্দিপাথার, ময়রাপুর, কারবিলং, কৃষ্ণাই অঞ্চলের গারো ও মণিপুরি আদিবাসীরা ভেন্না চাষ করেন গুটিপোকার খাদ্য হিসেবে। যা আমাদের দেশে গুটি পোকার খাদ্য হিসেবে তুত গাছের পাতা ব্যবহার করে। গুটি পোকা ভেন্না পাতা খেয়ে বলের মত যে ডিম দেয় তা দিয়ে তারা সুতা তৈরি করেন এবং সেই সুতা দিয়ে আদিবাসী পোষাক (দকমান্দা, দকশাড়ি, ওড়না, চাদর, গামছা প্রভৃতি) তৈরি করেন।” তিনি আরও বলেন, “ঐসব এলাকার আদিবাসী নারীরা ঘরে বসেই নিজস্ব পোষাক তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের এই পেশা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভেন্না গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করছে।” তিনি মনে করেন ত ভেন্নার এই উপকারিতা সম্পর্কে জানলে মানুষ এটি সংরক্ষণে উদ্যোগী হবে।
এই থেকেই আসলে বোঝা যায় ভেন্না গাছ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাকৃতিক সম্পদ-উদ্ভিদ। আমাদের উচিত এই উদ্ভিদকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করা ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। যাতে করে বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের মানুষ এই গুণাবলী সম্পর্কে জানতে পারে।