একজন বিনোদিনী মুন্ডার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল 
কৃষিক্ষেত্রে নারীর অবদান অনস্বীর্কায। পৃথিবীর সূচনা থেকেই নারী মানবসম্পদ উন্নয়নসহ সমাজ ও পারিবারিক কাজের সাথে সরাসরি জড়িত। কৃষির নানা ধরনের কর্মকান্ড, ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ, বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন, বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি ও ফসল উৎপাদন, সামাজিক বনায়ন প্রভৃতি কাজে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। কৃষিতে তেমনি এক সফল নারী বিনোদিনী মুন্ডা (৫৫)। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের আশ্রয়ন প্রকল্পে যাঁর বসবাস। স্বামী পরিত্যাক্তা হয়েও নিজের সন্তানদের নিয়ে তার এক সংগ্রামী জীবন তিনি গড়ে তুলেছেন।

11
আইলার পূর্বে বিনোদিনী মুন্ডা বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী গ্রামে বাস করতেন। কিন্তু ২০০৯ সালে সংঘটিত প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় আইলায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে গৃহহীন হয়ে পড়েন বিনোদিনী মুন্ডার পরিবারসহ অসংখ্য মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুভিটা বিচ্ছিন্ন প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর জনগোষ্ঠীর এক পূনবার্সন কেন্দ্র উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের আশ্রয়ন প্রকল্প। এটি স্থানীয়ভাবে ব্যারাক নামে পরিচিত। আইলার পর ব্যারাকে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ৩০টি জেলে, ২০টি আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়, ২০টি প্রান্তিক হিন্দু ও ৩০টি কাহার-মুসলিম পরিবারকে পূনবার্সন করা হয়। শুরুতে এখানকার পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ মরুভূমির মত। কেননা  সে সময়ে এখানে কোন সবজি বা সবুজ বৃক্ষ ছিল না। পর্যায়ক্রমে তাঁরা কৃষি কাজ শুরু করেন মৌসুমভিত্তিক নানা জাতের সবজি উৎপাদন; যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

খুলনা জেলার কয়রা থেকে স্বামী পরিত্যাক্ত হয়ে নিজের সন্তানদের (৩ ছেলে ও ১ মেয়ে) নিয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মহসিন সাহেবের হুলায় বসবাস শুরু করেন বিনোদিনী । সেখান থেকে  আইলা পরবর্তী সময়ে আশ্রয়ন প্রকল্পে পুর্নঃবাসিত হন এবং বর্তমানে মেজো ছেলে নেপাল মুন্ডার সংসারে থাকেন। বিয়ের পর থেকে সাংসারিক কাজের পাশাপাশি বসতভিটার সামান্য জায়গা পেলে সেখানে সময় উপযোগি নানা জাতের সবজি ফসল ফলাতেন। আশ্রয়ন প্রকল্পের নিজের ও ছেলের নামে ২টি ঘর থাকায় নিয়মানুযায়ী  তাদের বেডের ২ ভাগ জায়গা পান। ফলে বিনোদিনী মুন্ডা তার নিজস্ব জায়গায় মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন জাতের সবজি চাষের সুযোগ পান। বসবাসের শুরু থেকে তার নিজস্ব জায়গাতে সারাবছর বৈচিত্র্যময় নানা প্রজাতের সবজি চাষ করেন। তাঁর নির্ধারিত জায়গাটুকুর চারপাশ ফাঁস জাল দিয়ে এমনভাবে বেড়া দেন যাতে করে সেখানে কোন গবাদি পশু পাখি প্রবেশ করে ক্ষতি করতে না পারে।

বিনোদিনী বছরব্যাপী মৌসুমভিত্তিক ফসল উৎপাদন করেন। তাঁর ক্ষেতের অভ্যন্তরে নানা প্রজাতির সবজি ও ফসল ভিন্ন ভিন্ন প্লট করে লাগানোর কৌশল দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে তিনি কতখানি পরিচ্ছন্ন সবজি চাষী। জৈব পদ্ধতিতে নিবিড় যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন করেন সব ধরনের সবজি ও ফসল।

22
এ প্রসঙ্গে বিনোদিনী মুন্ডা বলেন, “আমি আগে কখনও এত বেশি জায়গা পাইনি, এখানে আসার পর থেকে দু’ভাগ জায়গা (৬ শতকের মত) নিয়ে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারছি, বছরের বারোমাস প্রায় আমার কোন তরকারি কেনা লাগে না, নিজের লাগানো সবজি টাটকা তুলে খাই, এতে কোন বিষ দেই না”। তিনি সারাবছর মৌসুমভিত্তিক কুশি, ঝিঙ্গা, তরুল, সীম, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, ঢেড়ষ, কামরাঙা ঢেড়ষ, বেগুন, ঝাল, পুঁইশাক, ডেমোশাক, টমেটো, পালংশাক, লালশাক, তরমুজ, ওল, হলুদ, কচুরমূখী, উচ্ছে, লাউ, কলমীশাক, মূলা, ওলকপি, বাঁধাকপি, বীটকপি, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ধনচে, আঁখ ও ধান সবজি/ফসল চাষাবাদ করেন। প্রতিটা সবজির প্লটের চারপাশ আইল দিয়ে আলাদা করেছেন এবং তাঁর ক্ষেতের মাঝখান বরাবর দিয়ে এমন সুন্দর ড্রেন তৈরি করেছেন যা দেখে সহজেই সকলের নজর কাড়ে। ক্ষেতের পাশেই মিষ্টি পানির পুকুর থাকায় তাঁর ফসল চাষে তেমন কোন সমস্যা হয় না। কলসের দ্বারা পুকুর থেকে ড্রেনের মাধ্যমে সবজি ক্ষেতে পানি দেন।

মৌসুমভিত্তিক ফসল চাষের জন্য তিনি প্রায় সব ধরনের বীজ নিজের কাছে সংরক্ষণ করে রাখেন পরবর্তীতে লাগানোর জন্য। তাঁর বসতভিটায়, ফলজ বৃক্ষ হিসেবে আম, কলা, নারকেল, পেঁয়ারা, সবেদা, জামরুল, লেবু, তাল, খেঁজুর, কেওড়া, কদবেল, লিচু, কুল, তেঁতুল, আমলকি, গবেদা, ডালিম, কাঁঠাল, পেঁপে বনজ বৃক্ষ হিসেবে নিম, রেইনট্রি, খদি, বাবলা, আকাশমনি, মেহগনি, সাই বাবলা, সেজি, ঔষধি হিসেবে হেন্না, থানকুনি, হেলাঞ্চ, কলমি, খুদকুড়ি, গাদমনি, গিমেশাক, নোনা গড়গড়ে প্রভৃতি লাগিয়ে রেখেছেন।
কৃষির পাশাপাশি বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও শুকর পালন করেন। এছাড়াও তাঁর রয়েছে নৌকা ও মাছ ধরার জাল। প্রয়োজনেই ঝাঁপিয়ে পড়েন নদীতে। সুন্দরবন সংলগ্ন চুনা নদী থেকে নানা প্রজাতির চিংড়ি, আমাদি, বেলে, পারশে, টেংরা, লুচো, কটকটি, ফেসা প্রভৃতি মাছ ধরে পারিবারিক আমিষের চাহিদা পূরণ করেন।

কঠোর পরিশ্রমী ও উদ্যোগী পঞ্চাশোর্ধ বিনোদিনী মুন্ডা সবজি চাষের সফল নারী হিসেবে বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্পের সকলের কাছে একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত। নিবেদিতপ্রাণ সমাজের এসব নারীদের লোকায়ত জ্ঞানের সম্মান ও স্বীকৃতি প্রয়োজন। তবেই স্থায়িত্বশীল কৃষিচর্চা বৃদ্ধি পাবে।

happy wheels 2