দুলাল মিয়ার কৃষিবাড়ি
নেত্রকোনা থেকে মো. আলমগীর
কৃষি প্রধান বাংলাদেশ কিন্তু কৃষক আর কৃষি আজ সবচে’ অবহেলার শিকার। সবুজ বিপ্লব, আধুনিক কৃষি, অধিক উৎপাদন উন্নয়ন যাই বলি না কেন সকল কিছুর দ্বারাই বর্তমান কৃষকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা। দিনকে দিন কমে যাচ্ছে কৃষক, কৃষক আন্তঃনির্ভরশীলতা, সহযোগিতা, জ্ঞান অভিজ্ঞতা ও পরস্পর বিনিময় প্রথা। এই পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহ তারাকান্দা উপজেলার বিশকা ইউনিয়নের খিচা গ্রামের দুলাল মিয়ার (৪২) বাড়িতে পা রাখলেই চোখে পড়ে ভিন্ন দৃশ্য, বদলে যায় ধ্যান-ধারণা, মানুষ হয় অনুপ্রাণিত। শৈশব থেকেই গৃহশিক্ষক বাবার হাত ধরে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করে পরিশ্রম আর সহভাগিতার মধ্য দিয়েই তিনি কৃষিতে জ্ঞান, দক্ষতা অর্জন করেন। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাই দুলাল মিয়াকে করেছে প্রকৃত কৃষক আর অপার আগ্রহ, উদ্যোগ ও নিজস্ব চিন্তা প্রতিফলিত হলো তার কৃষক নিয়ন্ত্রিত কৃষি বাড়ি।
দুলাল মিয়া জানান, মাত্র ৯৬ শতাংশ জমির একপাশে বসতঘর পুরো জায়গা সারি সারি ফলজ, ঔষধি, বনজ গাছ আর সবজির প্লট/মাচা। এ বাড়িতে ১২ মাসই হরেক রকম ফসল চাষ করেন তিনি। নিজে খাবার পর প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবজি বাজারে বিক্রি ও নিকট আত্মীয়দের মাঝে বিতরণ করেন। তার চাষ পদ্ধতিতে সবজির বীজ এবং স্থানীয় জাতের ধান বীজ তিনি নিজেই সংরক্ষণ করেন। তিনি কেবল নিজেই করেন না তিনি বরং খিচা জাগ্রত কৃষক সংগঠনের সদস্য হিসেবে তিনি গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের মধ্যে বীজ বিনিময়, সংরক্ষণের পরামর্শ ও সহযোগিতা করেন। দুলাল মিয়া বলেন, “গত একবছরে আমি ১৫ জাতের (ধান ও সবজি) বীজ ৮৪ জন কৃষকের মধ্যে বিতরণ/বিনিময় করেছি”।
দুলাল মিয়ার বাড়িতে আম, জাম, কাঁঠাল, পেঁয়ারা, লিচু, জাম্বুরা, বিলেম্বু, তাল, আমড়া, খেঁজুর, পেঁপে, বেল, নারকেল, সুপারি, কামরাঙ্গা, ডালিম, কমলা, বড়ই, জলপাই, লেবু, তেতুল, সাজনা, আতাফল, জামরুল, কদবেল, সফেদা, চালতা রয়েছে। ঔষধি গাছ হিসেবে রয়েছে হরতকি, তেজপাতা, পান, বাসক, থানকুনি, আপন, ধুতুরা, লজ্জাবতী, ডালিম, খারাজুরা, নিম, এরাইচ এবং বনজ হিসেবে রয়েছে শিমুল, বান্দরলড়ি, বদ্দিরাজ, রেন্ট্রি, ছেদাউজা, কালাউজা, বাঁশ, শীল কড়ই, শেউড়া, মাছেরকাটা, পটই, রঙ্গি, চাউ আছে। সবজির মধ্যে আছে আলু, বেগুণ, বাটিশাক, সিম, লাউ, লালশাক, ডাটা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, ধুন্দল, পুইশাক, কচ, মুখিকচু, পাটশাক, টমেটু, করলা, মূলা, সরিষাশাক, ঝিংগা, চিচিঙ্গা, কাকরুল, আলু শাক, ঢেরস, কাচা কলা, বরবটি। এছাড়া অন্যান্য ফসলের মধ্যে রয়েছে আদা, হলুদ, মাছ আলু, পাট, মরিচ, পেয়াজ, রসুন, গুয়ামুড়ী, গজআলু, মাসকালাই ও আখ রয়েছে। দুলাল মিয়া সবজি চাষের পাশাপাশি প্রাকৃতিক উপায়ে বেড়ে ওঠা অচাষকৃত উদ্ভিদও যতœ ও সংরক্ষণ করেন। তাঁর যতেœ ও সংরক্ষণে অচাষকৃত উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কচু, কলমিশাক, এলুঞ্চি, দলকলস, খুরেশাক, কচুর লতা, বিলাতি ধনিয়া পাতা। তিনি বলেন, “এই সকল কিছুই আমি যতœ সহকারে সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করি।”
সরজমিনে আমরা দেখতে পাই তিনি জমি চাষ করেন তার নিজস্ব গরুর লাঙ্গলে। তার পালনে ৫টি গরু, ৩টি ছাগল, ৬টি হাঁস, ৩০টি মুরগি, একজোড়া কবুতর রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে পোষা প্রাণি একটি কুকুর ও দু’টি বিড়াল।
ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে দুলাল মিয়া নিজের তৈরি কেচো কম্পোষ্ট, গর্ত কম্পোষ্ট, কুইক কম্পোষ্ট, ছাই, গোবর এবং জৈব বালাই নাশক ব্যবহার করেন। এতে তার উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়, তার প্রয়োজনের ৬০% চাহিদা পূরণ করে। তিনি জৈব ব্যবস্থাপনা, বীজ সংরক্ষণ, পশুপালনের উপর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছেন। নিজস্ব আগ্রহ, চিন্তা, ভাবনা ও প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানের সমন্বয়ে তিনি এখন গ্রামে দক্ষ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছেন। তার এই অর্জিত জ্ঞান জনউন্নয়ন কেন্দ্র, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষক সভা এবং এককভাবে সহভাগিতা করে থাকেন। তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন, ও প্রয়োগ, বীজ সংরক্ষণ, পশুপালন, জৈবসার উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রী অনুপ্রেরণাদাতা হিসেবে কাজ করেন। কৃষিতে সফলতার অংশীদার তাঁর স্ত্রীর সমন্বয়েই পরিচালিত হয় তাঁর সংসার বলে তিনি জানান।
বর্তমানে তার বাৎসরিক গড় আয় প্রায় ৯০,০০০ নব্বই হাজার টাকা এবং প্রতিবছরই দুলাল মিয়া তার সাংসারিক খরচ বাদে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে গড়ে ৫০,০০০ পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করেন।
দুলাল মিয়া পড়ালেখার সুযোগ না পেলেও তার ছেলে মেয়েদের তিনি সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চান। এক ছেলে ও দুই মেয়ে মা এবং স্ত্রী মিলে ৫ সদস্যের সংসার তাঁর। তাঁর ছেলে পড়ালেখার পাশাপাশি কৃষি কাজে সহযোগিতা করে। দুলাল মিয়া বলেন, “আমি আমার বাবার মাধ্যমে প্রকৃতি এবং পরিবেশ থেকে যে জ্ঞান পেয়েছি, আমার ছেলে-মেয়েদেরও সেই জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে যেতে চাই। তারা যদি কোনদিন কোন অফিসে চাকুরি করে সেখান থেকে যেন তারা এদেশের অসহায় কৃষকদের পক্ষে কথা বলতে পারে”।