শুদ্ধভাবে মায়ের ভাষাকে জানতে কিশোরী সংগঠনের উদ্যোগ

নেত্রকোনা থেকে মো. আলমগীর ও শংকর ম্রং

আজ বারসিক রামেশ্বরপুর রির্সোস সেন্টারে ‘সকল দূর্যোগ ও বিনাশের বিরুদ্ধে আমার আছে একুশ’ স্লোগানকে সামনে রেখে রামেশ্বরপুর আমরা করবো জয় কিশোরী সংগঠনের উদ্যোগে উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে “শুদ্ধভাবে মায়ের ভাষাকে জানি” শিরোনামে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা, মর্যাদা ও চর্চা বৃদ্ধিতে এক শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে ৫টি কলেজ ও দু’টি স্কুলের ৪১ জন শিক্ষার্থী (নারী-৩২) অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দি ওয়েষ্টার্ণ কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মিস আমিনা সুলতানা হেপী, অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে ছিলেন একই কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মিস ফারজানা আক্তার এবং আইটি প্রভাষক মোজাহিদ। অনুষ্ঠানটি মূলত দু’টি অংশে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অংশে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আলোচনা এবং দ্বিতীয় অংশে শিক্ষার্থীদের শুদ্ধ ভাষায় লেখা ও বলা চর্চা।

IMG_20190219_105039

আমরা করবো জয় কিশোরী সংগঠনের সদস্য মিলি আক্তারের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সুচনা করা হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির আহবায়ক সুইটি আক্তার ও বারসিক’র কর্মসূচি কর্মকর্তা মো. আলমগীর। মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে আলোচনা অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন বারসিক এর সহযোগি সমন্বয়কারী শংকর ম্রং।

IMG_20190219_110221

আলোচনা অনুষ্ঠানে শংকর ম্রংবলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসটি বাঙালি তথা বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের কবল থেকে রক্ষায় বাংলার আপামর ছাত্রজনতা বুকের রক্তে রাজপথ রাঙিয়েছিলেন। শহীদ হয়েছিলেন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার। আরও শহীদ হয়েছিল রাজমিস্ত্রির ছেলে অহিউল্লা ও রিক্সা চালক আব্দুল আউয়াল। বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষি ছাত্রজনতার আন্দোলনের মূখে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালির দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং বাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালির দাবি মেনে নিয়ে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিলে বাঙালির উপর বিভিন্ন কায়দায় অত্যাচার নিপিড়ন চালাতে থাকে। সরকারি বিভিন্ন চাকীিতে এবং বড় বড় পদে বাঙালিদের নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করে রাখেন। কিন্তু বাঙালি ছাত্রজনতা এই বৈষম্যের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলেন, যে আন্দোলন এক পযার্য়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। এ আন্দোলন চুড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও প্রায় ত্রিশ লাখ তাজা প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করে। প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন বাংলাদেশের।’ শংকর ম্রং বলেন, ‘আমাদের দেশটি ৪৭ বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করলেও এই স্বাধীন দেশে এখনও সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা পায়নি। বিশেষভাবে বর্তমান প্রজন্মের নিকট এখনও বাংলা ভাষা শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদাহীন। বর্তমান প্রজন্মের নিকট ইংলিশ ও হিন্দি ভাষা যতটা গুরুত্ব পায়, বাংলা ভাষা সে তুলনায় কম গুরুত্ব পায়। ফলে বর্তমান প্রজন্ম নিজের মাতৃভাষা বাংলা শুদ্ধভাবে লিখতে (বানান) ও লিখতে বলতে (উচ্চারণ) পারেনা। বর্তমান সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠদানের ক্ষেত্রেও শুদ্ধভাবে লেখা ও বলার উপর খুব একটা প্রাধান্য দেয়া হয় না। যা, শিক্ষার্থীদের ভূল বানান ও ভূল উচ্চারণ প্রমাণ করে।’

IMG_20190219_112519
প্রভাষক মিস অমিনা সুলতানা হেপী তার আলোচনায় বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি নামটি বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক নাম। কেননা ফেব্রুয়ারি মাসে বাঙালি ছাত্র জনতা তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে নিশ্চিহ্ন করতে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের তৎপরতা থেকে রক্ষায় দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ছাত্রজনতা রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা রক্ষা পায়। কিন্তু আমরা বর্তমান প্রজন্ম বাংলা ভাষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে ভিন দেশী/জাতির পেশার প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করছি। ফলশ্রুতিতে আমরা বাঙালিরা মাতৃভাষা বলতে গিয়ে এবং লিখতে গিয়ে অহরহর ভুল বানান ও ভূল উচ্চারণ করি, যা’ মাতৃভাষার প্রতি এবং ভাষা শহীদ ও ভাষা সৈনিকদের প্রতি অসম্মান করার সামিল। আমরা করবো জয় কিশোরী সংগঠন বারসিক’র সহায়তায় মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলা ও লেখা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সত্যি প্রশংসাযোগ্য। আমরা আশা করি আজকে থেকে মাতৃভাষা বাংলা লেখা ও বলার ক্ষেত্রে সর্বদা সচেতন হবো। মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলা ও লেখা চর্চার মাধ্যমেই ভাষা শহীদের প্রতি সত্যিকারের সন্মান প্রদর্শন করা হবে।’

IMG_20190219_124038
দ্বিতীয় অংশে শিক্ষার্থীদের শুদ্ধভাবে বাংলা লেখা ও বলা চর্চায় শ্রোতলিপির আদলে বাংলায় ভাষায় ১২টি লাইন অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের লিখতে দেওয়া হয়। এই কাজের মাধ্যমে সেসব শব্দগুলোর শুদ্ধ বানান ও শুদ্ধ উচ্চারণ সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা জেনেছে। শিক্ষার্থীদের লেখা শব্দগুলোর শুদ্ধ বানান বোর্ডে লিখে দেয়া হলে শিক্ষার্থীরা তাদের ভূলগুলো ঠিক করে নেয়। বাংলা বানান লেখা শেষে শিক্ষার্থীরা বাংলায় বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ২০টি লাইন সামনে এসে পাঠ করে। এসময় তারা পরস্পরের বাংলা শব্দের ভূল উচ্চারণগুলো শুধরে দিয়ে শব্দগুলোর শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে সক্ষম হয়।

অনুষ্ঠানটি আয়োজনের ফলে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষা বাংলা শুদ্ধভাবে লেখা ও বলা চর্চার শপথ গ্রহণ করেছে। তারা নিজ মাতৃভাষার পাশাপাশি অপরাপর জাতি গোষ্ঠীর ভাষার প্রতি সন্মান ও মর্যাদা প্রদানেরও অঙ্গীকার করে। তারা বাঙালি জাতির ন্যায় অন্য কোন জাতিকে যাতে রক্ত দিতে না হয় সেজন্য সকল জাতি ও ভাষার প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ করার অঙ্গীকার করে।

happy wheels 2

Comments