ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন আনসার আলী ও শাহনাজ
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
নদীর মতই মানুষের জীবন ও বাঁকে বাঁকে ভরা। মানুষ জীবন চলার পথে নদীর মতই দিক পরিবর্তন করে। মানুষের পথ চলাও নদীর সর্পিল পথের মতই। জীবন পথে চলতে মানুষ কখনো সফল হয় আবার কখনও সফল হতে পারে না। সফলতা পেতে-স্বাচ্ছন্দ পেতে অনেক চেষ্টা করেও যখন কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না এমন সময় পেশার পরিবর্তন করতে বাধ্য হন পাবনার চাটমোহর উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের জবেরপুর গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে আনসার আলী (৪০)। সাত আট বছর আগে চাটমোহর পৌরসদরের নিকটস্থ ভাদুনগর মোড়ে ছোট একটি মুদী দোকান ছিল তাঁর। কোন জমা জমি ছিল না। সাংসারিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ঠিকমত দিন পাত চলছিল না। বাড়িতে প্রতিবন্ধী সন্তান। সব মিলিয়ে যখন একটা হযবরল অবস্থা। এমন সময় চাটমোহরের রেলবাজার এলাকার ফয়সালের কাপড়ে ডিজাইন করা জড়ি পুতির কাজ দেখে উৎসাহী হন আনসার আলী। তিনি মুদী দোকান ছেড়ে শুরু করেন কাপড়ে ডিজাইন ও জড়ি পুতির কাজ। এ কাজে তার স্ত্রী শাহনাজ পারভীন সার্বক্ষণিক তাকে উৎসাহ অনুপ্রেরণা যোগান এবং সব রকমের সহায়তা করেন। স্ত্রী’র সার্বিক সহায়তায় এ কাজ শুরুর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আনসার ও শাহনাজের। এখন স্বপ্ন কেবল অনাগত দিন নিয়ে। ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন আনসার আলী ও তার স্ত্রী শাহনাজ। এখন চমোহরের প্রায় ১৩টি পয়েন্টে তিন শতাধিক নারী শ্রমিক কাজ করেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আনসারের আখি জড়ি পুতি হাউজে।
শাহনাজ বলেন,“ আট বছর যাবত এ কাজের সাথে আমরা যুক্ত। কয়েক বছর পূর্বে অন্যদের নিকট থেকে অর্ডার নিয়ে কাজ করলেও গত চার বছর যাবত ঢাকার এস পি ফ্যাশন এবং প্যারাডাইস এ দুটি গার্মেন্টস এর সাথে সরাসরি কাজ করছি। গার্মেন্টস কতৃপক্ষ কাপড় সূতা চুমকী পাথর আঠাসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিষপত্র সরবরাহ করে। মেয়েদের থ্রিপিস এর গলার ডিজাইন এর কাজ করি।” তিনি আরও বলেন, “কাজ অনুয়ায়ী প্রতিটির জন্য সর্বোচ্চ ২শ’ ৫০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পাই আমরা। কাজ করার পর সেগুলো গার্মেন্টস এ দিয়ে দেই। আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। ছেলে শাহীনের বয়স আঠারো বছর। ও ছোট বেলা থেকে প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারেনা। চেষ্টা করে। উঠে দাঁড়াতে পারে না। সারাক্ষণ শুয়ে থাকে। মেয়ে আল্পনা আক্তার আখি ছোট শালিখা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া লেখা করছে। নিজে বাড়িতে কাজ দেখা শুনা করি, ছেলে মেয়েদের সময় দিতে পারি, অর্থনৈতিকভাবেও স্বচ্ছলতা পাচ্ছি সব মিলিয়ে ভালো আছি।”
আনসার আলী বলেন, “ডিজাইন, জড়ি, পুতির কাজ শুরু করায় একটা বেহাল অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি আমি। চাটমোহরের জগতলা, মথুরাপুর, শিবপুর, বালুদিয়ার, চরপাড়া, পাথাইল হাটসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত ১৩টি সেন্টারে প্রায় তিন শতাধিক নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। পূর্বে যে ঋণ ছিলাম তা শোধ করে দিয়েছি। মোটরসাইকেল কিনেছি। দশ কাঠা জমিও বন্ধক রেখেছি। সেখানে চাষাবাদ করি। খাবার ধান চাল হয়ে যায়।” তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, “অনেক সময় ঢাকার গার্মেন্টসএ টাকা আটকে থাকে। কিন্তু শ্রমিকদের তো বেতন মজুরি দিতে হয়। তখন কোন কোন সময় সমস্যায় পরি। সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পাই না। জমা জমির কাগজ দিতে হয়। আমারতো জমাজমি নেই। তাই ব্যাংক ঋণ পাই না। বাধ্য হয়ে বেসরকারী সংস্থা থেকে ঋণ নিতে হয়। এসব ঝক্কি ঝামেলা থাকলেও সব মিলিয়ে ভালো আছি।”
আনসার আলীর আখি জড়ি পুতি হাউজে সুপার ভাইজার হিসেবে কাজ করছেন জবের পুর গ্রামের শুকজান খাতুন। স্বামী হাসান আলী একজন চায়ের দোকানদার। ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করে শুকজান মাসে বেতন পান ২ হাজার ৫শ’ টাকা। নিজের বাড়ির কাজও দেখাশুনা করতে পারেন তিনি। বিভিন্ন এলাকায় পৌছে দেওয়ার জন্য উপকরণ প্যাকেট করা এবং মালামাল বুঝে নেওয়ার কাজ করেন তিনি। পাশাপাশি আনসারের বাড়িতে কর্মরত শ্রমিকেরা যে কাজ করেন সেটিও দেখাশুনা করেন। শুকজান বলেন, “এখানে কাজ করে যে টাকা পাই তা সংসারে সহায়ক ভূমিকা রাখে।” সারোরা গ্রামের বারেক আলীর মেয়ে ময়না খাতুন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া লেখা করেছেন। এরপর আর পড়ালেখার সুযোগ হয়নি। ময়না বলেন, “বাবা একজন কৃষি শ্রমিক। অন্যের জমিতে কাজ করেন। সংসারে অভাব অনটন আছে। তাই পরিবারকে সহায়তার জন্য আট বছর যাবত এ কাজ করছি আমি। মাসে ৩ হাজার ৬শ’ টাকা বেতন পাই। জবেরপুর গ্রামের আব্দুস সামাদের মেয়ে হুসনা খাতুন ৬ মাস যাবত এ কাজ করছেন।” হুসনা বলেন, “অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর ঢাকায় চলে যাই। সেখানে একটি গার্মেন্টস এ কাজ করি কিছু দিন। এর পর এলাকায় ফিরে এসে এখানে কাজ শুরু করি। মাসে ২ হাজার ১শ’ টাকা বেতন পাই আমি। আমার এ বাড়তি আয় টুকু সংসারের কাজে লাগাই।”
কেবল শুকজান, ময়না বা হুসনা নয় এমন প্রায় তিনশতাধিক নারী শ্রমিক আনসারের আখি জড়ি পুতি হাউজে কাজ করছেন এখন। সামনে ঈদ তাই ব্যস্ততা বেড়েছে তাদের। বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরাও বাড়তি সময়টুকু কাজে লাগিয়ে করছেন কিছু বাড়তি আয়। এ কাজে সম্পৃক্ত প্রায় সকলেই অভাবী পরিবারের স্ত্রী কন্যা। একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উদ্যোগ নিয়ে এমন কাজে সম্পৃক্ত হওয়ায় এলাকার অনেক নারী শ্রমিক খুব বেশি না হলেও যতটুকু আয় করার সূযোগ পেয়েছেন সেটাকেই তারা যথেষ্ট মনে করে কাজ করছেন প্রতিদিন। তাদের হাতের ছোয়ায় কারুকার্যে পোশাকে যে সৈন্দর্য ফুটে উঠছে; মানুষ পছন্দ করে তাদের তৈরি ডিজাইনের কাপর পরছে এতেই তৃপ্ত তারা।