জ্বালানি সাশ্রয় ও পরিবেশবান্ধব চৃুলা
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
“বাংলাদেশ অহন ডিজিটাল অইছে, সব কিছুই সহজ। আমরা পিছায়া থাকবাম ক্যারে? সারাদিন আমরার কত কাম-কাজ করণ লাগে। শহরে সুইচ টিপলেই রান্ধা অইয়া যায়। আমরার তো সেই সুবিধা নাই। লাকড়ি যোগাড় করো, চুলা জ্বালাও, কত্ত কাম। রানতে রানতেই দিন শেষ। তারপর আছে ধোঁয়ার সমস্যা। রান্ধনের ঝামেলা দূর করণের লাইগ্যা একটা চুলা বানাইছি। অহন কাম কইরা কিছু আরাম পাওয়া যায়। এই চুলায় খুব তাড়াতাড়ি রান্ধা অয়, লাকড়িও কম লাগে। বড় সুবিধা অইছে ঘরের ভিতর ধোঁয়া অয়না। শুনছি ধোঁয়ার কারণে নানা ধরণের অসুখ অয়। আমরা টের পাইনা। কত রোগ শরীরে বাসা বান্ধে। যহন টের পাই, তহন সব শেষ”। এভাবেই সেদিন একটি গ্রাম সভায় কথা বলছিলেন সাফিয়া আক্তার।
সাফিয়া আক্তার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের সুলতানগাতী গ্রামের একজন কৃষাণী। নিজের কোনো জমি জমা নেই। স্বামী আবুল হোসেন অন্যের জমিতে কাজ করেন। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। চার জনের সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই সাফিয়া আক্তার সংসারের চাহিদা মেটানোর জন্য কাপড় সেলাইয়ের কাজও করেন। তাছাড়া বাড়িতে বিভিন্ন ফলজ গাছ আছে। মৌসুমী ফল বিক্রি করেও সংসারের খরচ কিছুটা লাঘব হয়।
ছোটবেলা থেকেই তাঁর বিভিন্ন নতুন জিনিস শেখার প্রতি আগ্রহ ছিল। তাঁর মা যখন চুলা তৈরি করতেন, তখন তিনি পাশে বসে দেখতেন। এভাবে এক প্রতিবেশির কাছ থেকে কাপড় সেলাইও শিখেছেন। গ্রামের অন্যদের কাছ থেকে দেখে তিনি বিভিন্ন ধরনের চুলা তৈরি করা শিখেছেন। নিজ গ্রামের অনেকের বাড়ি ছাড়াও তিনি নেত্রকোণা সদরের মালনী এলাকার ঋষিপাড়ার নারীদের চুলা (আলকাটা দ্বি-মুখি চুলা) তৈরি করতে শিখিয়েছেন।
সম্প্রতি তিনি একটি জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরি করেছেন। তাঁর এই চুলা তৈরি একদিনের ফসল নয়। গত ২০১৫ সালের শেষের দিকে সুলতানগাতী গ্রামে জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলার প্রদর্শন ও গ্রামীণ খেলাধূলার আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি চুলা তৈরি করে দ্বিতীয় স্থান দখল করেন। বারসিকের সহায়তায় এর জন্য তাঁকে পুরষ্কৃত করা হয়। মেলাতে পুরষ্কার পাওয়ার পর তার উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। মেলায় পুরষ্কার প্রাপ্ত চুলাটি বর্তমানে এই গ্রামের অনেকেই ব্যবহার করছে। পুরষ্কার প্রাপ্তি ও তার তৈরি চুলার ব্যবহারÑ এই দুটি কারণে নতুন করে আরো কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন তিনি।
২০১৬ সালের আগস্ট মাসে এই চুলা তৈরি বিষয়ে আরো অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামের বন্ধু চুলা প্রস্তুতকারী মো. আবুল মিয়ার বাড়ি পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি বন্ধু চুলা তৈরির বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হন। এই চুলা তৈরির উপকরণ সম্পর্কেও ভালোভাবে ধারণা লাভ করেন।
এরপর বাড়ি এসে তিনি জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরির প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। অতীতের তৈরিকৃত চুলা, বন্ধু চুলার প্্রযুক্তি ও নিজের মেধার সমন্বয়ে তিনি এই চুলাটি তৈরি করেন। উন্নত বা বন্ধু চুলা থেকে এই চুলার পার্থক্য হলো এটি তৈরি করতে খরচ হয় খুব সামান্য। বন্ধু চুলা প্রস্তুতকারী মো. আবুল মিয়ার সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই চুলার উপকরণের মধ্যে পাইপ, চিমনি, ছাকনি, সিমেন্ট ও বালির প্রয়োজন হয়। যা কিনতে প্রায় ১৫০০ (এক হাজার পাঁচশত টাকা) টাকার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাফিয়া আক্তারের চুলায় মাত্র ৩৩০ (তিনশত ত্রিশ টাকা) টাকা লাগে। উপকরণের মধ্যে শুধুমাত্র পাইপ, চিমনি ও মাটির প্রয়োজন হয়।
স্থানীয় জাতের অন্যান্য চুলার সাথে এই চুলার তুলনামূলক পার্থক্য করা হয়। এখানে দেখা গেছে স্থানীয় চুলায় ভাত রান্না করতে সময় লাগে ২০Ñ২৫ মিনিট। আর এই চুলায় সর্বোচ্চ ১৬ মিনিট। তরকারিতে সাধারণ চুলায় সময় ব্যয় হয় ২০ মিনিট, পরিবেশবান্ধব চুলায় ১২-১৪ মিনিট। লাকড়িও লাগে খুব কম। একবার ভাত, তরকারি রান্নার জন্য প্রায় ২.৫ কেজি লাকড়ির প্রয়োজন হয়। হিসাব করে দেখা গেছে, একটি পরিবার প্রতিদিন দুই বেলা রান্না করতে যদি ৫ কেজি লাকড়ি লাগে, তবে এক মাসে লাগবে ১৫০ কেজি বা ৩ মণ ৩০ কেজি। সাধারণ চুলায় লাকড়ি লাগে এর দ্বিগুণ।
সময়, অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি এই চুলায় কালি হয়না। কারণ পাইপ বা নলের সাহায্যে ধোঁয়া বাইরে বের হয়ে যায়। শুধুমাত্র পাতিলের নিচের অংশে আগুনের তাপ লাগে। চুলা থেকে আগুন বাইরে বের হতে পারেনা। পাতিলের নিচের অংশে কালি জমে বলে প্রতিদিন পাতিল পরিষ্কার করতে হয় না। পরিশ্রম কম হয়। ঘরে ধোঁয়া হয় না বলে কোনো রোগ বালাইয়েরও আশংকা নেই। ঘরে বা কাপড়ে কালি জমেনা। চোখ জ্বালা করেনা, হাঁচিও আসে না। জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব এই চুলায় যে কোনো ধরণের জ্বালানি ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ নেত্রকোণা অঞ্চলে যে ধরণের জ্বালানি পাওয়া যায় যেমন, লতা পাতা, খড়, লাকড়ি, বাঁশের কঞ্চি, গোবরের ঘুটি ইত্যাদি জ্বালানির সাহায্যে রান্না করা যায়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন ভাবে লাগেনি। শহরাঞ্চলে ঘর গৃহস্থালির প্রতিটি কাজ সহজে করার জন্য অনেক আধুনিক উপকরণ আছে। সেই উপকরণের সাহায্যে কাজ করে শহুরে জীবন হয়েছে গতিশীল। আর গ্রামীণ জীবনে দৈনন্দিন কাজের সকল উপকরণ নিজেদের যোগাড় করে নিতে হয়। রান্না করার সময়, অর্থ, শ্রম ও জ্বালানি ইত্যাদি সাশ্রয় করে যদি প্রতিদিনের কাজ করা যায় তবে গ্রামীণ জীবনেও গতিশীলতা আসবে। পাশাপাশি নারীদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মূল্যায়নের মাধ্যমে নারীর কাজ স্বীকৃতি লাভ করবে।