উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে যিনি ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছেন তিনি হীরালাল সেন। মানিকগঞ্জের কৃতী পুরুষ হীরালাল সেনের নাম উপমহাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্থান দখল করে আছেন। লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের চলচ্চিত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষকে চমকে (নতুন রঙ্গে রাঙ্গিয়ে) দেয়ার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এই উপমহাদেশে হীরকের দীপ্তি দিয়ে সর্ব বলিষ্ঠ মাধ্যমটির প্রথম সূর্যোদয় ঘটান এক বাঙ্গালি তরুণ; তার নাম হীরালাল সেন। এই বাংলাদেশেই তার জন্ম।
মানিকগঞ্জে আড়ম্বতায় ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী
গত ২ আগস্ট হীরালাল সেনের ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে তার জন্মভিটা মানিকগঞ্জ শহরের পাশে বকজুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গনে। দিনটি পালিত হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। হীরালাল সেন স্মৃতি পরিষদ ও তরুণ চলচ্চিত্রকারেরা মিলে হীরালাল সেনের বাড়ি মানিকগঞ্জের বকজুরী গ্রামে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। হীরালাল সেনের নামে মানিকগঞ্জে ‘হীরালাল সেন’ সড়ক উদ্বোধন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে পাইয়োনিয়ার এই নির্মাতার নামে সড়ক উদ্বোধন করা হয়। ‘হীরালাল সেন’ সড়কের নাম ফলক উদ্বোধন করেন মানিকগঞ্জের মেয়র গাজী কামরুল হুদা সেলিম। এ সময় ফিল্ম আর্কাইভের সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এদিন বকজুরী বিদ্যালয় মাঠে তার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয় শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়া সুধী সমাজের উদ্যোগে স্মরণসভা ও সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়।
রাতে বেসরকারী উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা বারসিক আয়োজন করে আলোচনা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর। এসময় উপস্থিত ছিলেন, হীরালাল সেন স্মৃতি সংসদ সদস্য সচিব অধ্যাপক মীর মোকছেদুল আলম, জেলা প্রশাসক নাজমুছ সাদাত সেলিম, জেলা পরিষদের প্রশাসক গোলাম মহিউদ্দিন, চলচ্চিত্র গবেষক ও সাবেক সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন, তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ইকবাল হোসেন কচি, ঘাতক দালাল নিমূল কমিটির সভাপতি এডভোকেট ভোকেট দীপক ঘোষ, উদিচি সাধারণ সম্পাদক মোস্তফিজুর রহমান মানুন, জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান মাাস্টার, স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল জলিল। খেলাঘর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আলমাছ, বারসিক-এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায়, প্রগতি লেখন সাহিত্য সাধারন সম্পাদক নজরুল ইসলাম প্রমুখ। এসময় বক্তারা হীরালাল সেনের স্মৃতি রক্ষার্থে কয়েকটি দাবী তুলে ধরেন কর্তৃপক্ষের কাছে।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
হিরালাল সেন মানিকগঞ্জের বগজুরী গ্রামে ১৮৬৬ সালে আগস্ট মাসের শ্রাবণী পূর্ণিমায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম চন্দ্রমোহন সেন, মাতা বিধুমুখী। হীরালালের পিতামহ দাদা গোলককৃষ্ণ সেন ছিলেন মানিকগঞ্জের বিখ্যাত জমিদার ও ঢাকার ডাকসাইটে উকিল। পরে তিনি কোলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে যোগ দেন। ঢাকার নবাব আব্দুল গণির সঙ্গে ছিল গোকুলকৃষ্ণ সেনের গভীর বন্ধুত্ব। তাঁর ছিল তিন পুত্র ও তিন কন্যা। চন্দ্রমোহন সেন ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র। চন্দ্রমোহন এম.এ ও বি-এল পাশের পর ঢাকা কোর্টের উকিল হন। তিনি বিয়ে করেন দিনাজপুরের বিখ্যাত সেরেসতাদার শ্যামচাঁদের মেয়ে বিধুমুখীকে। চন্দ্রমোহনের চার পুত্র ও চার মেয়ের মধ্যে হীরালাল সেন ছিলেন দ্বিতীয়। পরবর্তীকালের বিখ্যাত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের শ্বশুর ছিলেন আদিনাথ সেন। আদিনাথ সেনের ছোট ভাই নরনাথ সেন ছিলেন হীরালাল সেনের মেয়ে (তৃতীয় সন্তান) প্রতিভা সেন (তথি)-এর স্বামী। পিতা মাতার আট সন্তানের মধ্যে হীরালাল ছিলেন দ্বিতীয়। মানিকগঞ্জ মাইনর স্কুলে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। একই সাথে মৌলভী সাহেবের কাছে ফারসী ভাষাও শিখতেন। ১৮৭৯ সালে মাইনর পরীক্ষা পাস করে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্ত্তি হন। পরে পিতার সাথে হীরালাল কোলকাতা গিয়ে কলেজে ভর্ত্তি হন। আই.এস.সি. অধ্যয়নকালে চলচ্চিত্রের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পরেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার যবনিকাপাত ঘটে।
সংসার জীবন
হীরালাল বিয়ে হয় হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে। হীরালাল সেনের পুত্র-কণ্যারা হলেন সুরবালা দেবী, প্রফুলল বালা দেবী, প্রতিভা দেবী (তথি) ও বৈদ্যনাথ সেন। প্রথম পুত্র বৈদ্যনাথ সেন ১৯০২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তৃতীয় সস্তান মেয়ে প্রতিভা সেন তথির বিয়ে হয় নরনাথ সেনের সাথে। নরনাথ সেনের ভাইপো দিবানাথ সেনের স্ত্রী ছিলেন কিংবদন্তির নায়িকা সুচিত্র সেন।
কেমন ছিল হীরালাল সেনের পিতৃভিটা
হীরালাল সেনের বগজুরি গ্রামের বাড়ি ছিল রাজবাড়ির মতো। ৩৯-৪০ বিঘা জমি নিয়ে। এর মধ্যে ৪-৫ বিঘা জমি নিয়ে ছিল বাগান, ছিল পদ্মপুকুর, চিড়িয়াখানা, নানা শিল্পসৌকার্যম-িত দালানকোঠা এবং নাটমন্দির। বাড়িতে নিয়মিত কবিগান, কীর্তন, নৃত্য, সঙ্গীতচর্চা, পূজা উৎসব হতো। সেকালে তাঁদের বাড়ির নাটশালার মতো এত বড় নাটমন্দির বঙ্গদেশে খুব কমই ছিল বলে ড. দীনেশচন্দ্র সেন উল্লেখ করেছেন।
শুরুর কথা
হীরালাল সেনের কল্যাণে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা নতুন দিগন্তের রূপ পায়। স্কুলের ছাত্রাবস্থা থেকে হীরালাল সেনের ফটোগ্রাফীর প্রতি ছিল দারুণ আগ্রহ। স্টিফেন্স নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক কলকাতায় বায়োস্কোপ দেখাতে শুরু করেন স্টার থিয়েটার মঞ্চে। অন্যান্যের মতো বায়োস্কোপ দেখে বিস্মিত হলেন হীরালাল। হীরালাল সেন নানা বিষয় জানার জন্য স্টিফেন্সের কাছে যান। কিন্তু ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ভেবে হীরালালের কাছে তার গোপন রহস্য গোপনই রেখে দেন। তাতে অবশ্য হীরালাল দমে যাননি। তিনি বিদেশ থেকে বায়েস্কোপের যন্ত্রপাতি জোগাড় করে এনে যথারীতি তা দেখাতে শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন ভাই মতিলাল সেন ও ভাগ্নে ভোলানাথ গুপ্ত। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ৪ এপ্রিল তিনি গঠন করেন রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানি এবং কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে প্রদর্শনী করেন। একই সালে বায়োস্কোপ দেখান ভোলার এসডিও’র বাংলোতে। ১৮৯৮ সালে হীরালাল সেনের তোলা স্থিরচিত্র ভারতীয় শিল্প ও কৃষি প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক পায়। সেই সঙ্গে শুরু হয় হীরালাল সেনের জয়যাত্রাও। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায়ও বায়েস্কোপ প্রদর্শিত হয় সদর ঘাটের ক্রাউন থিয়েটারে। রয়েল বায়েস্কোপ কোম্পানি পরে বাংলাদেশে আরো অনেক এলাকায় বায়োস্কোপ দেখায়। এর মধ্যে রয়েছে হীরালাল সেনের জস্থান বগজুরি, জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদ (১৫ এপ্রিল, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ), ঢাকার নবাববাড়ি (২০ ও ২৪ মার্চ, ১৯১১ খ্রিসটাব্দ)।
প্রথমে বায়োস্কোপ দেখার মাধ্যমে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয় চলচ্চিত্রের নির্মাণ প্রসঙ্গে। প্রত্যহ বিকেলে হীরালাল সেন স্থানীয় তাবুতে গিয়ে বায়োস্কোপ দেখার নেশা ছিল। পরে পিতা চন্দ্রমোহন সেনকে বায়োস্কোপ কিনে আনতে আগ্রহ সৃষ্টি করে। ছেলের উৎসাহ উদ্দিপনা দেখে পিতা আরো উৎসাহিত হয়ে উঠেন। ১৮৯০ সালে প্রথমদিকে মানিকগঞ্জের নিজ বাড়িতে তিনি এইচএল সেন এন্ড ব্রাদার্স নামে একটি ফটোগ্রাফিক স্টুডিও খোলেন। এক পর্যায়ে বিদেশী সিনেমার মেশিন এনে হীরালাল সেন দি রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠন করেন। ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল এই কোম্পানির মাধ্যমে চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীর আয়োজন করে এবং সেই বছর বরিশালের ভোলায় এসডিও’র বাংলাতে ছবি প্রদর্শন করেন। ১৯০১ সালে হীরালাল সিনেমার কাজে হাত দেন। তিনি তৎসময়ে মঞ্চ নাটকের নির্বাচিত অংশে চিত্রগ্রহণ করেন। চিত্তগ্রহণকৃত তিনটি নাটক হলো ১. বঙ্কিম চন্দ্রের সীতারাম ২. তারনাথের সুবল ৩. আলীবাবা।
কর্মজীবন
সেসময় এক প্রচন্ড উত্তেজনা। প্রথমে মুভি ক্যামেরা চালিয়ে আলো জ্বালিয়ে ছবি তোলার কাজ শুরু করেন। ব্যাপক উৎসাহ উদ্দিপনা তাকে নিয়ে যায় চলচ্চিত্রের নির্মাণের সফলতার দ্বারে। সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে হীরালাল সেন আজো অমর হয়ে আছে। দাদা সাহেব ফালকের নাম ভারতীয় সিনেমার অগ্রনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ১৯১৩ সালে তার ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার সুবাদে। অথচ হীরালাল সেনের প্রথম ছবি মুক্তি পায় ১৯০৩-এ। ইতিহাসের এক নিদারুণ ট্রাজেডির নায়ক হীরালাল। সেই সময়ের (১৮৯৮) তুলনায় অবিশ্বাস্য দামে (পাঁচ হাজার টাকা) জন ইলিয়ট কোম্পানির মাধ্যমে ইংল্যান্ড থেকে যিনি সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্র কিনেছেন। ১৯০০ সালে ‘পুকুরে স্নান’ ও ‘কোটের খেলা’ নামে দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় হীরালাল সেনের চলচ্চিত্র নির্মাণ, পরিকল্পনা ও প্রযোজনার অভিযাত্রা। চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াসে তিনি ১৮৯৬ সালে যুক্ত হন এবং ১৯০০ সালের মধ্যেই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯০০ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি ৮০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এর মধ্যে রয়েছে কাহিনীচিত্র (নাটকের খ-দৃশ্য), তথ্যচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও বিজ্ঞাপনচিত্র। এসব ছবির দৈর্ঘ্য ছিল ৫০ ফুট থেকে ২৫০ ফুট। ১৯০৪ সালে উপমহাদেশের প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ‘আলীবাবা ও চল্লিশ চোর’ নির্মাণ করেন তিনি। ১৯০৩ সালে তার রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানি থেকে প্রথম বাংলায় সিকে সেনের মাথার তেল ‘জবাকুসুম’, বটফেস্ট পালের ‘এডওয়ার্ড টনিক’ ও ডব্লিউ মেজর কোম্পানির ‘সালসা পিলা’ প্রভৃতি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মিত হয়। তাছাড়া তিনি প্রামাণ্যচিত্র ও সংবাদচিত্রও নির্মাণ করেন।
হীরালাল সেন চলচ্চিত্রপঞ্জি
কাহিনিচিত্র : ১. ভ্রমর; ২. আলিবাবা; ৩. হরিরাজ; ৪. দোল লীলা; ৫. সরলা; ৬. বুদ্ধ; ৭. সীতারাম। (১৯০০-১৯০১ সময়সীমায় তোলা এই ছবিগুলোর দৈর্ঘ্য ১০০ থেকে ১৫০ ফিট পর্যন্ত) ৮. দুটি প্রাণ; ৯. মৃণালিনী; ১০. সোনার স্বপন; ১১. মনের মতন; ১২. মজা; ১৩. বধূ; (১৯০২-১৯০৫ সময়সীমায় তোলা এই ছবিগুলোর দৈর্ঘ্য ২০০ থেকে ৩০০ ফিট পর্যন্ত—বিদেশ থেকে ক্যামেরা এনে নতুন ক্যামেরায় তোলা) ১৪. চাবুক; ১৫. গুপ্তকথা; ১৬. ফটিকজল; ১৭. দলিতা ফনিনী (১৯০৩-১৯০৫ সময়সীমায় তোলা ছায়াছবি)।
সংবাদচিত্র
১. করোনেশন দরবার-দিল্লি (১৯০৩); ২. করোনেশন দরবার-কলকাতা (১৯০৩); ৩. গ্র্যান্ড প্যাট্রিওটিক ফিল্ম; (১৯০৫); ৪. সুরেন্দ্রনাথের শোভাযাত্রা (১৯০৫); ৫. দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (১ম) (১৯১১-১২); ৬. দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (২য়) (১৯১১-১২); ৭. দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (৩য়) (১৯১১-১২); ৮. দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (৪র্থ) (১৯১১-১২); ৯. দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (৫ম) (১৯১১-১২); ১০. দিল্লি কলকাতার দরবার চিত্র (৬ষ্ঠ) (১৯১১-১২)।
তথ্যচিত্র
১. পথের ছবি; ২. গঙ্গার ঘাটের ছবি; ৩. প্যাথে নৃত্য দৃশ্য; ৪. প্যাথে ছবি (গুচ্ছ) (১৯০০ সালে তোলা); ৫. চিত্পুর রোডে চলমান দৃশ্য; (১৯০০-১৯০১ সময়সীমায় তোলা ছায়াছবি); ৬. বগজুরি গ্রামের বিবাহোত্সব; ৭. বগজুরি গ্রামের স্নানার্থী তথ্যচিত্র (১৯০২-১৯০৩ সময়সীমায় তোলা ছায়াছবি); ৮. রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ির বিবাহেৎসব; ৯. দুলিচাঁদ মল্লিকের বাড়ির বিবাহোৎসব; ১০. শিবচরণ লাহার বাড়ির বিবাহোত্সব; ১১. রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ির বিভিন্ন উত্সব; ১২. শিবচরণ লাহার বাড়ির বিভিন্ন উত্সব (১৯০২-১৯০৫ সময়সীমায় তোলা ছায়াছবি)।
প্রচারচিত্র
১৩. এডওয়ার্ড অ্যান্টি ম্যালেরিয়া স্পেসিফিক কোম্পানির পেটেন্ট ওষুধ; ১৪. জবাকুসুম তেল (সি কে সেন-এর আগরপাড়া বাগানবাড়িতে গৃহীত); ১৫. সার্সাপেরিলা (ডব্লিউ মেজর কোম্পানির তৈরি। সি কে সেনের বাগানবাড়িতে গৃহীত) ১৯০৩ সালে তৈরি।
ট্র্যাজেডিময় শেষ জীবন
চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাস সৃষ্টিকারী হীরালাল সেনের শেষ জীবন সুখের হয়নি। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভাই মতিলালের সঙ্গে মতদ্বৈততার কারণে রয়েল বায়োস্কোপ ছেড়ে যোগ দেন ল-ন বায়োস্কোপ কোম্পানিতে। সেখানে তিনি কাজ করেন একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে। কিন্তু সেখানেও টেকেনি বেশিদিন। রামদত্ত নামে অপর এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে মিলে তিনি তৈরি করেন সিনেমা হল। কিন্তু এখানে তিনি চরম প্রতারণার শিকার হন। এসব ঘটনায় তাঁর মন ভেঙ্গে যায়। তিনি প্রবল আর্থিক সঙ্কটে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর একমাত্র সম্বল দুটি ক্যামেরা, আংটি মলিলক (পান্না বাবু) এর কাছে বন্ধক রেখে টাকা নেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন মেয়েকেও। পরে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫১ বছর বয়সে ১৯১৭ প্রয়াত হোন তিনি। মৃত্যুর সময় তাঁর শয্যাপাশে ছিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর মৃত্যুতে শোকবার্তা প্রেরণসহ অর্থসহায়তা করেছিলেন পরিবারকে। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দেবি চলে আসেন তার দেবর নারায়ণগঞ্জের জজ দেবকীলালের কাছে। ১৯২১ খ্রিসটাব্দে এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
স্বীকৃতি না পেলেও ভারতবর্ষের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে বলা হয় তার নাম। আমাদের দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের এই সন্তান যিনি কিনা সমগ্র উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক; বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে, কর্মে, স্মরণে তার নাম খুবই কম উচ্চারিত হয়। অসাধারণ সৃজনী সামর্থ্যে উজ্জ্বল উপমহাদেশের এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত হীরালাল সেনের অবদান হীরার দ্যুতি স্মরণীয় হয়ে থাকবে বিশ্ববাসীর কাছে।