ইয়ারবের গাছের পাঠশালা
আসাদুল ইসলাম, সাতক্ষীরা থেকে
আমাদের আশেপাশে থাকা বহু গাছ আছে যার অনেক গুণ আছে অথচ আমরা জানিনা। আমাদের অনেক চেনা গাছ আছে যা এখন আর দেখি না। আবার এক অঞ্চলে দেখলেও অন্য অঞ্চলে দেখা যায় না। বহু গাছ বিলুপ্তির পথে। আমাদের বাপ-দাদারা যে সব গাছ দেখেছে তা আমরা আর দেখি না। আবার আমরা যা দেখছি হয়তো পরের প্রজন্ম তা দেখতে পাবে না। গাছ নিয়ে এমন আক্ষেপ হয়তো সবাই করবে।
কিন্তু গাছ নিয়ে এমন আক্ষেপ দূর করতে, হারিয়ে যাওয়া গাছ ধরে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মকে গাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে সাতক্ষীরার তুজুলপুরে ইয়ারব হোসেন গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমধর্মী গাছের পাঠশালা। প্রায় ৪০০ প্রজাতের ঔষধি, বনজ ও ফলজ গাছের সমাহার ঘটিয়েছেন তার গাছের পাঠশালায়।
সকাল থেকে রাত অবধি ইয়ারব তার গাছের পাঠশালায় নিজ হাতে কাজ করেন। গাছের জন্য মাটি প্রস্তুত করা, গাছ লাগানো ও গাছের পরিচর্যা করা এসব যেন নিত্য দিনের রুটিন কাজ তার। তার এই কাজে সহযোগিতা করেছেন তুজুলপুর কৃষক ক্লাবের সদস্যবৃন্দ। যুক্ত করেছেন এলাকার যুবকদের। যে কেউ পাঠশালায় এলে ইয়ারবে হেঁটে হেঁটে প্রতিটি গাছের গুনাগুণ সম্পর্কে অনরগল বলতে থাকেন। যারা যাচ্ছেন গাছের পাঠশালায় তারাই মুদ্ধ হচ্ছেন। অবাক হচ্ছেন গাছের সমারহ দেখে। প্রতিদিন ভীড় করছে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ। ইতিমধ্যে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, মিডিয়া ব্যক্তিত্বসহ অনেকে প্রশাংসা করেছেন ইয়ারবের এই ব্যতিক্রমধর্মী কাজের।
গাছগুলোকে তাদের প্রধান ব্যবহার অনুসারে ঔষধি, বনজ, ফলজ, অচাষকৃত ও মসলা উদ্ভিদবৈচিত্র্য অনুসারে ভাগ করে পাঠাশালা সাজানো। ইচ্ছা আছে ৭ শতাধিক ফলজ, বনজ, ঔষধি, অচাষকৃত, মসলা উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণে।
ইয়াবরের গাছের পাঠশালায় যেসব গাছ রয়েছে তার মধ্যে অশোক, শতমূল, অন্তমূল, নাগিনী, উলটকম্বল, কালধুতরা, বনটেপা, সাদা চিচচিড়ে, ত্রিমোহী, পারিজাত, কেয়াফুল, ভূতরাজ, বিলম্বি, জবা, নীলকন্ঠ, গর্জৃন, পুদিনা, ভূই কুমড়া, রসনা, আমলকি, বৌঘুমটা, গুয়ে বাবলা, হাতিশুড়, শিয়াল কাটা, গুয়েলতা, নীলাঝি, সাদা ধুতরা, উনরাজ, অশোক, এড়কচু, অড়হড়, দূর্বা, সুবর্ণলতা, শম্ভুজবা, জাফরং, ছাতিম, খূয়ের, মোহুয়া, নাগদানা, নয়নতারা, হেন্না, কলমি, বনঝুরি, ঘৃতশুমারি, স্বর্পগন্ধা, অশ্বগন্ধা, ক্যাংড়া, কনকচাপা, কৃষ্ণকলি, বাকসা, ডালিম, লালকচু, দস্তাকচু, লালচেরি, সাদাচেরি, নিম, বাদাম, রক্তসেজি, বকফুল, কুলনচো, সাদাসেজি, হরিতকি, বহেরা, শ্বেতচন্দন, রক্তচন্দন, বাইননুটি, শিষনাগ, ফণিমনসা, শিবজটা, লাল লজ্জাবতি, সাদা লজ্জাবতি, শ্বেতবেড়াল, ঘেটকুল, সঞ্চি, ইশানমূল, চিতা, তকমা, কাজুবাদাম, পুদিনা, পলাশ, কেলেঝি, নীলকণ্ঠ, পানিকা, উঁইরাজ, দুধলতা, আতাড়ি পাতাড়ি, আমরুল, কাটানটে, পাথরকুচি, তেলাকচু, হেলাঞ্চ, সূর্যসূখি, খুদকেসড়ে, ভীমরাজ, বউটুনি, থানকুনি, চিনিগাছ, লালকেউটে, হাড়ভাঙ্গা, কুমারীলতা, তমাল, নেড়াসেঝি, তরুফচন্দাল, পেঁপে, তরমুজ, রক্তকরবী, সাদাকরবী, কটলেবু, চেরিফল, ড্রাগন, বাতাবিলেবু, কাগজিলেবু, চায়না লেবু, আপেল, আঙ্গুর, লেচু, কুল, আম, জাম, ছবেদা, ঔল, কালকচু, নাগিনী, আশফল, মিষ্টি তেঁতুল, কাউফল, জলপাই, আলমুন্ডা, ডেবু, জামরুল, আমড়া, কদবেল, খুরমা, বেদানা, গাব, করমুচা, মাকালফল, পেঁয়ারা, চায়না পেয়ারা, দেশী পেয়ারা, নোনা, কাঠবাদাম, ইছুপগুল, ডালচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ, জয়ফল, তেজপাতা, চুইঝাল, হলুদ, বকুলফুল, গোলাপ, গেন্দা, মোরগ ঠনঠনে, মানকচু, সজিনা, কলা, ঘাসফুল, বেল, চালতা, অর্জন, গর্জুন, শিশুফুল, জিবলি, মনামনি, বাগঝামা, লেমনট্রি, লেমন, কুজ, বুজ, অলমিট মসল্যাসহ প্রায় ৪০০ জাতের বিভিন্ন গাছ।
এছাড়া ইয়ারবের পাঠশালায় আছে ৫৮ জাতের আম, ৩০ প্রজাতে অচাষকৃত শাক-লতাপাতা, ১২ জাতের কলা, ৮ জাতের কুল, ১৪ জাতের জবা, ৪ জাতের তুলসীসহ বিভিন্ন জাতের ফলজ, বনজ, ঔষধি গাছ।
ইয়ারবের পাঠশালায় সুন্দরবনের গাছ সংরক্ষণ করে চলছে সুন্দরবন কর্ণার এর কাজ। গড়ান, গেরয়া, কেওড়া, বাইন, কাঁকড়া গাছ, গোলপাতা গাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। আরো সংগ্রহ করা হচ্ছে। যেখান থেকে সুন্দরবনের গাছের পরিচিতি মিলবে।
শুধু গাছ সংরক্ষণ নয় ইয়ারবের গাছের পাঠশালা থেকে এলাকার মানুষের মাঝে গাছ বিতরণও করা হচ্ছে। প্রায় ৬০০ ডালিম গাছের চারা দেওয়া হয়েছে। এক হাজার কদবেল, পাঁচশত পেঁপে ও দুইশত জামের চারা প্রস্তুত করা হচ্ছে দেওয়ার জন্য। এছাড়া এখান থেকে প্রায় ৬০/৭০ জন কে গাছড়া ঔষধ দেওয়া হয়েছে।
গাছের পাঠশালার উদ্যোক্তা ইয়ারব হোসেন বলেন, “যেসব গাছ হারিয়ে যাচ্ছে সেসব গাছ সংরক্ষণ করা, বিভিন্ন এলাকার গাছকে এক জায়গায় এনে মানুষকে চেনানো, বিভিন্ন গাছের গুনাগুণ তুলে ধরা, নতুন প্রজন্মের সামনে গাছকে তুলে ধরতে আমার এই উদ্যোগ। আমার ভালোবাসা গাছের সাথে। আর এই ভালোবাসা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই।”