কৃষকের পেনশন স্কিম এবং ১৮ খাদ্যযোদ্ধা

কৃষকের পেনশন স্কিম এবং ১৮ খাদ্যযোদ্ধা

আসাদুল ইসলাম, সাতক্ষীরা থেকে

কৃষকের পেনশন
‘যাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেই কৃষকই জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে খাদ্য, চিকিৎসা ও আবাসিক সংকটে পড়ে অনিশ্চিত জীবনযাপন করে। অথচ দেশের এই বড় অংশের কর্মসংস্থান নিশ্চিতে সরকারকে কখনো ভাবতে হয়নি। কিন্তু এখন কৃষকের শেষ জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভাবার সময় এসেছে। তাই কৃষক পেনশন স্কিম চালু করতে হবে।’

সম্প্রতি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০১৬ উপলক্ষে খাদ্যযোদ্ধা কৃষক-কৃষাণীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বারসিক আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এই দাবি জানান।

বক্তারা আরও বলেন, আর্থিক সমস্যার কারণে কৃষকরা উৎপাদিত ফসল মৌসুমের শুরুতেই বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায় ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাই ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতসহ পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ করতে হবে।

সভায় তুজলপুর কৃষক ক্লাবের সভাপতি ইয়ারব হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সভাপতি আনিছুর রহিম, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, দৈনিক দক্ষিণের মশাল সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী, সনাক-সাতক্ষীরার সদস্য কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম কামরুজ্জামান, স্বদেশের নির্বাহী পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জোৎ¯œা দত্ত, বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী শাহীন ইসলাম, সাতক্ষীরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা টিমের আহবায়ক আসাদুল ইসলাম, কৃষক আবু মুছা, কৃষক ইমদাদুল হক প্রমুখ।
sat-1-2
১৮ খাদ্যযোদ্ধা
দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে অসামান্য অবদান রাখায় সম্প্রতি সাতক্ষীরার ১৮ খাদ্যযোদ্ধা কৃষক-কৃষাণীকে বারসিক’র পক্ষ থেকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননাপ্রাপ্তরা হলেন, কলারোয়া উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের আকলিমা খাতুন, শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের কৃষক নিরঞ্জন জোয়ারদার, শ্যামনগরের চুনা নদীর চরে নির্মিত ব্যারাকের আদিবাসী নারী বিনোদিনী মুন্ডা, পদ্মপুকুরের কৃষক হাকিম গাজী, পাখিমারা গ্রামের গৃহিনী নাসরিন নাহার, মানিকখালী গ্রামের কাঞ্চন রানী বৈদ্য, গড়কুমারপুর গ্রামের হামিদা খাতুন, কালমেঘা গ্রামের কৃষ্ণপদ গাইন, অর্চনা রানী, চিংড়াখালী গ্রামের রাসিদা বেগম, চকবারা গ্রামের কৃষক আবু মুসা, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মাছখোলা গ্রামের আশুরা বেগম, জেয়ালা গ্রামের কৃষক ইমদাদুল হক, আলিপুর গ্রামের কৃষক ইউছুফ গাজী, তুজলপুর গ্রামের তুজলপুর গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর কবীর, মাহমুদপুরের ইউনুচ আলী, সাতক্ষীরা শহরের পুষ্টির ফেরিওয়ালাখ্যাত রুহুল কুদ্দুস রনি ও আশাশুনি উপজেলার গোঁদাড়া গ্রামের বাবর আলী।

সম্মাননাপ্রাপ্তদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-
আকলিমা খাতুন: সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের মৃত সামছুদ্দীন সরদারের মেয়ে আকলিমা খাতুন উচ্চ শিক্ষিত হয়েও চাকুরির আশা ছেড়ে করছেন কৃষিকাজ, ধরেছেন সংসারের হাল। ঘুরিয়েছেন ভাগ্য, পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক।

নিরাঞ্জন জোয়ারদার: নিরাঞ্জন জোয়ারদার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ১১শ বিঘা কৃষি জমি রক্ষা করতে আজীবন সংগ্রাম করে চলেছেন। তারই প্রচেষ্টায় স্থানীয় কৃষকরা কৃষিকাজের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলাচ্ছেন সোনার ফসল।

আশুরা বেগম
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মাছখোলা গ্রামের আশুরা বেগম জলাবদ্ধতা জয় করে মাছ ও সবজি চাষে ঘুরিয়েছেন ভাগ্যের চাকা।
বিনোদিনী মুন্ডা: লবণাক্ত মাটিকে সবুজ স্বপ্নভূমি তৈরীর কারিগর বিনোদিনী মুন্ডা থাকেন শ্যামনগরের চুনা নদীর চরে তৈরী ব্যারাকে।

রুহুল কুদ্দুস রনি: প্রকৃতির কবি রুহুল কুদ্দুস রনি অচাষকৃত কুড়িয়ে পাওয়া শাক-সবজি সংরক্ষণ ও পুষ্টি সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছেন এক যুগ।

বাবর আলী: কোন প্রকার প্রকল্প ছাড়াই জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে পুষ্টির প্রাকৃতিক উৎস, কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যজগতের ব্যবহার, বিকাশ, সচেতনতা ও চর্চা বাড়ানোর মহান দায়িত্ব পালন করছেন আশাশুনির যুবক বাবর আলী।

আবু মুসা: শ্যামনগরের গাবুরার চকবারা গ্রামের কৃষক আবু মুসা ৫ শতাধিক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে সংঘটিত করে লবণ সহনশীল ধান ও অন্যান্য ফসলের জাত সংগ্রহ করে লিপ্ত রয়েছেন ফসল উৎপাদনের সংগ্রামে।

ইমদাদুল হক: ৩০ বছর ধরে এলাকার কৃষকদের ধান, আলু, হলুদ ও সরিষা চাষে পরামর্শ দিয়ে আসছেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের জেয়ালা গ্রামের কৃষক ইমদাদুল হক।

হাকিম গাজী: লবণাক্ত জলবায়ু জয় করে কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ খামার বাড়ি তৈরী করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন কৃষক হাকিম গাজী।

নাসরিন নাহার: লবণ পানি এবং লবণ মাটির সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় পদ্মপুকুর ইউনিয়ন বাসীর। এই ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামের গৃহিনী নাসরিন নাহার আইলার পর মৌসুমভিত্তিক সবজি চাষ করে এখন সফল। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সবজি বাজারে বিক্রি, আত্মীয় স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের খেতে দেন।

কাঞ্চন রানী বৈদ্য: এক সময় কৃষিকে বাদ দিয়ে চিংড়ী চাষ শুরু করেন শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের মানিকখালী গ্রামের কাঞ্চন রানী বৈদ্য। কিন্তু অবস্থা খারাপ দেখে আবারও কৃষি আঁকড়ে ধরেন জীবন জীবিকার তাগিদে। নিজ জমি ও জমি বর্গা নিয়ে স্বামীর সাথে সারাবছর কৃষি কাজ করেন এই নারী। ফসলের বীজ বাড়ীতে সংরক্ষণ করেন এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করেন জৈব সার। জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এই নারী অন্যান্য নারীদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন নিরাপদ জীবনযাপনের।

ইউসুফ গাজী: মাছের বন্ধু ইউছুফ গাজী। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ লালন পালনে সময় কাটে তাঁর।

হামিদা খাতুন: লবণাক্ত জলবায়ু জয় করে কৃষি বাড়ি তৈরীর নারী যোদ্ধা হামিদা খাতুন।

কৃষ্ণপদ গাইন: কৃষি ও কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কালমেঘা মানবকল্যাণ কৃষক সংগঠন তৈরীর সফল নায়ক কৃষক কৃষ্ণপদ গাইন। জেলার শ্যামনগর উপজেলার কালমেঘা গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের সংগঠিত করে প্রায় এক যুগ ধরে সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।

অর্চনা রানী: আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে নারীরা নিবিড়ভাবে জড়িত। এভাবে বসত বাড়িতে খাদ্য উৎপাদন করে খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রেখে চলেছেন শ্যামনগরের অর্চনা রানী।

জাহাঙ্গীর কবীর: সাতক্ষীরা সদর উপজেলার তুজলপুর গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর কবীর এলাকায় পরিচিত আদর্শ কৃষক হিসেবে। তিনি ফসলের ক্ষতিকর পোকা দমনে উদ্ভাবন করেছেন নতুন কৌশল।

রাসিদা বেগম: কৃষি ও প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে জীবনযুদ্ধে এখন সুখি রাসিদা বেগম। জমি কিনেছেন, ঘরও তৈরী করেছেন এবং মেয়ে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন। রাসিদা এখন চিংড়ীখালী গ্রামের অনুপ্রেরণা।
ইউনুচ আলী: খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সাতক্ষীরার অহংকার আপাদমস্তক খাদ্যযোদ্ধা কৃষক ইউনুচ আলী। বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়েছেন। জীবনের ৭০ বছর রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, বন্যা, খরার সাথে সংগ্রাম করে ফসল উৎপাদন করেছেন দেশ ও জাতির জন্যে।

happy wheels 2