৫২টি পুকুরের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে

তানোর, রাজশাহী থেকে মো. সবজুল হোসেন

রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দ ইউনিয়নের ২২টি পাড়া নিয়ে মোহর গ্রাম। এ গ্রামটি তালন্দ উইনিয়নের সব থেকে বড় গ্রাম বলে পরিচিত। এ গ্রামে হিন্দু, মুসলিম ও আদিবাসী সম্প্রদায় মিলে প্রায় দুই হাজার ৬শ’ টি পরিবার লোকের বসবাস। গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত। পানি বরেন্দ্র অঞ্চলে অতীতের একটি সমস্যা। পানি সঙ্কট দূর করার জন্য তাই এই অঞ্চলের প্রতিটি বসতির আশেপাশে উল্লেখযোগ্য হারে পুকুরের সংখ্যা লক্ষ্য করা যায়। এ থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে অতীতে এ এলাকার মানুষ পুকুরের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। মোহর গ্রামের অবস্থান বরেন্দ্র অঞ্চলে হওয়ার কারণে এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫২টি পুকুরের অবস্থান। বয়স্ক ব্যক্তিদের মতে, এই পুকুরগুলোর মধ্য কোনটি ২০০ বছর, কোনটি ১৫০ বছর আবার কোনটি ৫০ থেকে ৩০ বছরের পুরোনো। এ থেকে বুঝা যায় যে বিদ্যুৎ চালিত পানি উত্তোলন যন্ত্র আসার আগে এই গ্রামের জনগোষ্ঠি দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানির একটি বড় অংশ পুকুর থেকে সংগ্রহ করতেন।
dsc01554-22
গ্রামের পানি ব্যবহারে অতীত অবস্থা
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অতীতেও এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম ছিল। বছরের আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে তুলনামূলকভাবে বেশি বৃষ্টিপাত হত। মূলত বৃষ্টির পানি ধরে রাখার উদ্দ্যেশ্যই এই গ্রামে পুকুরগুলো খনন করা হয়েছিলো। যাতে করে এলাকার মানুষ তাদের সারা বছরের পানি চাহিদা পূরণ করতে পারেন।এ বিষয়ে মোহর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি মো. আলী বক্স (৮১) বলেন, “আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগেও আমরা পুকুরের পানি দিয়েই সকল কাজ করতাম। এমনকি এই পানি আমরা ফুটিয়ে খাওয়ার কাজে ব্যবহার করেছি। গ্রামে তখন টিউবওয়েল ছিল না। তখন এই গ্রামে মাত্র দু’টি কুয়া ছিল। যা থেকেও পানি পাওয়া যেত।” তিনি আরও বলেন, “তবে চৈত্র বৈশাখ মাসে কুয়াতেও পানি কম উঠত। অতীতের কৃষি কাজে সেচ ব্যবস্থা মূলত প্রকৃতির উপরই নির্ভর ছিল। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে পুকুরের পানি দিয়েও সেচের কাজ চালানো হত বলে জানা যায়।”

গ্রামের পানি ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে মূলত ১৯৬০ সালের দিক থেকে পানির জন্য নলকূপ ব্যবহারের প্রচলন হতে থাকে এবং তা জনপ্রিয় হয় ১৯৭০ সালের দিকে এসে। মোহর গ্রামে প্রথম নলকূপ স্থাপন হয় ১৯৮২ সালের দিকে এসে। আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে এবং পুকুরগুলো ব্যবহার হতে থাকে মাছ চাষ, গোসল, গবাদীপশুর গোসল ও অল্প পরিমাণে সেচের কাজে। এরপর যখন সেচের কাজে গভীর নলকূপ ও ডিজেল চালিত ইঞ্জিন দিয়ে সেচের কাজ শুরু হলো তখন গ্রামের পুকুরগুলোর ব্যবহারও কমতে শুরু করল। পুকুরগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যখন বৈদ্যুতিক মটর ও বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ শুরু হয়। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই টিউবওয়েল ও বৈদ্যূতিক মটর ব্যবহার হচ্ছে এবং পকুরগুলোতে চলছে লিজের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ। গ্রামের কোন পরিবারই এখন দৈনন্দিন কাজে আর এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতে পারছে না। কারণ পুকুরে প্রতিনিয়তই রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন ঔষধ ব্যবহার করা হয়। এই প্রসঙ্গে গ্রামের গৃহিনী মোছাঃ রহিমা বেগম (৪৫) বলেন, “আমরা আর পুকুরের পানি কোন কাজেই ব্যবহার করি না। কারণ এই পানি ব্যবহার করার ফলে শরীরে বিভিন্ন চর্মরোগ যেমন চুলকানি ও ঘাঁ-পঁচরা রোগ হয় এবং এই পানিতে সবসময় একটি গন্ধ টের পাওয়া যায়, যা নাকি শরীরের জন্যও খারাপ।”

শেষ কথা
মাটির নিচ থেকে ক্রমাগত পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এবং পুকুরগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে রাসায়নিক ব্যবহার করে মাছ চাষের ফলে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের জীবনে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন নাম জানা ও না জানা বিভিন্ন রোগের প্রাদূর্ভাব। পরিবেশ ও মানুষের কথা বিবেচনা করে পুকুরগুলোকে লিজ মুক্ত করতে হবে। এছাড়া কম পানি প্রয়োজন হয় এমন শস্য-ফসলের চাষ প্রবর্তন করতে হবে যাতে পানির ওপর চাপ না পড়ে। এই উদ্যোগ এখন থেকেই নিতে হবে। তা না হলে এলাকায় পানির সঙ্কট আরও মহামারী রূপ ধারণ করবে।

happy wheels 2