বোনা পদ্ধতিতে আউশ ধান চাষ: চরের প্রধান ধান মৌসুম
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা:
মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার একটি বৃহদাংশ চর এলাকা। পদ্মা নদীর চরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। চরের মানুষের প্রধান জীবন-জীবিকা হলো কৃষি। উৎপাদিত কৃষি ফসল দিয়ে নিজেদের খাবার চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। পারিবারিক চাহিদার অতিরিক্ত ফসল বিক্রয় করে আবাদ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য গবাদি পশুপালন ও অন্যান্য খাতে ব্যয় করে থাকেন। কিন্তু চরের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দীর্ঘদিন। উৎপাদিত কৃষি পণ্য পরিবহনে চরের বাহন ঘোড়ার গাড়ি ও নদী পথে ইঞ্জিন চালিত নৌকার ব্যবহার করে থাকে।
পদ্মার চরে প্রতিবছর বন্যার পানিতে পলি পড়ায় কম খরচে ধান, ডাল, মসলা, তেল, শাকসবজি, গম, পাট, আখ ও ফল আবাদ হয়। বাঙালিদের প্রধান খাদ্য ভাত হওয়ায়, এক সময় বাংলাদেশে আউশ, আমন ধান চাষ ছিল প্রধান। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে বোরো মৌসুমে আবাদ হওয়ায় আউশ ধান চাষ প্রায় বিলুপ্ত। কিন্তু হরিরামপুরের লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের কবিরপুর, সেলিমপুর, হরিহরদিয়া, জয়পুর মাঠে নিয়মিত বোনা পদ্ধতিতে আউশ ধান চাষ করে আসছেন স্থানীয় কৃষকরা। বিস্তৃত মাঠগুলোতে তাকালেই দেখা যায় সবুজ বোনা আউশ ধান বাতাসে দুলছে, যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। জমিগুলোতে বছরের একটি মাত্র ফসল আউশ ধান চাষ হয়। বর্ষা মৌসুমে (আষাঢ় থেকে ভাদ্র) মাস পর্যন্ত বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকে। মাঠ থেকে পানি নেমে গেলে জমিগুলোতে জন্ম নেয় নলখাগড়া, কাইশ্যা, কলমি, খরমা, গইচা, বাদাল, দুর্বলা, জলদুর্বা, হেনচি, ইত্যাদি ঘাসে মাঠগুলো ভরে থাকে বলে আমন ধান চাষ করা সম্ভব হয় না। একারণে চরে আউশ মৌসুমই প্রধান ধান চাষের মৌসুম।
চরের মাঠকে মাঠ বোনা আউশ ধান চাষ শুরু হয়েছে। আগে সাধারণত গরু দিয়ে জমি চাষ করা হতো, এখন কলের লাঙল হওয়ায় তাড়াতাড়ি জমি চাষ করা যায়। কিন্তু তাতে কৃষকের খরচ বাড়ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের মতে, “এখন আমাদের নাঙ্গল চাঙ্গে উঠছে, কলের নাঙ্গলের পিছনে ছুটতে ছুটতে পা খয় হয়ে গেছে।” লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের হরিহরদিয়া গ্রামের কৃষক দেলোয়ার হোসেন (৪৫) বলেন, “আমি গরু দিয়ে জমি চাষ করি, জমিতে পরাঙ্গি (আউশ) ধান বোনি। এ বছর আমি ১০ বিঘা জমিতে (৫২ শতাংশে ১ বিঘা) আউশ ধান বোনি। আউশ ধান চাষে রাসায়নিক সার, বিষ লাগে না, খেতে স্বাদ লাগে, স্বাস্থ্য ভাল থাকে।” আউশ ধান চাষে আলো, বাতাস, মাটি ও পরিবেশ ভাল থাকে। চরের মানুষ সারা বছর সার বিষ ছাড়া উৎপাদিত আউশ চালেরই ভাত খায়। এসব খাবার খেয়ে চরের মানুষের অসুখ কম হয়। তাদের মতে, বাজার থেকে কিনে বি আর ২৯ ধানের চালের ভাত খেলে পেটে অসুখ (পেট ব্যথা) হয়। তবে এই এলাকায় আগে দুই প্রজাতির পরাঙ্গি ও কালো আউশ ধান চাষ হলেও বর্তমানে কালো আউশ ধান তেমন কেই একটা বোনে না। পরাঙ্গি ধানই সবাই চাষ করে থাকে। পরাঙ্গি ধানের চাল খেতে ভাল, কম খরচে উৎপাদনও ভালো হয়। আউশ ধান আবাদের মৌসুম শুরু হয় বৈশাখ মাসে। বছরের প্রথম মৌসুমে বৃষ্টি হলে মাটির জো বুঝে কৃষকেরা জমি চাষ করে বীজ বপন করে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেই ধান পরিপক্ক হয় এবং ধান কেটে ঘরে তোল যায়। চরের ৩৩ শতাংশ জমিতে ৮ থেকে ১০ মন বোনা আউশ ধান উৎপন্ন হয়। জমি চাষ ও বীজ বাদে অন্য কোন খরচ না থাকায় আউশ ধান চাষে কৃষকগণ লাভবান হচ্ছে। চরের কৃষকগণ আউশ ধান চাষে সারা বছরের খাবার সংগ্রহ করে, অতিরিক্ত ধান বিক্রয় করে ফসল বোনা, লেখাপড়াসহ অন্যান্য পারিবারিক খরচ নির্বাহ করে থাকে।
হরিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. জহিরুল হক বলেন, “চর এলাকার ঐতিহ্যই হচ্ছে বোনা আউশ ধান চাষ। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে আউশ ধান চাষাবাদ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। লেছড়াগঞ্জ চরে কৃষকগণ কম খরচে কালো আউশ, পরাংঙ্গি ধান চাষ করেন। গত বছর শ্রাবণ মাসের বন্যায় ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়। তবে কৃষকগণ বন্যা হলেও বীজ ধান সংগ্রহ করতে পারায় মাঠে আউশ ধান চাষ করা সম্ভব হয়। এ বছরও চরের কৃষকগণ বীজ সংগ্রহ করে আউশ ধান চাষ করেছেন। তাছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের কৃষি অফিস সহযোগিতায় রোপা আউশ ধান চাষ হচ্ছে। আউশ ধান চাষে চরের কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হবে।”
বাংলাদেশে এক সময় কালো আউশ, পরাংগি আউশ ধান সহ অসংখ্য প্রজাতির বোনা আউশ চাষ হতো। বর্তমানে দেশে আউশ মৌসুমে ধান চাষ নেই বলেই চলে। হরিরামপুরের চরাঞ্চলের কৃষকগণ কালো আউশ ও পরাঙ্গি জাতের ধান এখনো চাষাবাদ করেন। আউশ ধান চাষে কৃষকের খরচ খুবই কম হয়। মাটি ও পরিবেশ ভালো থাকে। গরুর খাবারের জন্য খড় পাওয়া যায় না। সার এবং বিষমুক্ত হওয়ায় অসুখ হয় না, স্বাস্থ্য ভাল থাকে। কৃষক নিজস্ব বীজ ধান দিয়ে চাষাবাদ করায় স্বাধীনভাবে বোনা আউশ ধান চাষ করতে সুবিধা হয়।