পাখির জন্য মায়া
রাজশাহী থেকে উপেন রবিদাস ও অমৃত সরকার
মানুষ-প্রাণ আর প্রকৃতির এক মিলনমেলা এই চকপাড়া গ্রাম। হাজারো পাখির কলকাকলীতে প্রতিদিন মুখরিত হয় এই গ্রাম। রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার ভালুগাছী ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রাম। গ্রামটির পূর্ব পাশে বিলকান্দা ও পশ্চিমে বিলসোনা কান্দর বিল। এই বিল দু’টিতে বছরে একবার কোন রকম বোরো ধান চাষ করা গেলেও সারাবছর আর কোন ফসল হয় না। বিলে প্রচুর পরিমাণ ছোট বড় শামুক, মাছসহ অনেক জলজ প্রানীর আবাসস্থল। এই গ্রামকে কেন্দ্র করেই হাজার হাজার শামুখখোল ও বাদুুরের বসবাস। কথা হচ্ছিল এই গ্রামের সাধারণ কিছু মানুষের সাথে যারা তাদের কাজ দিয়ে একটি অসাধারণ ইতিহাস তৈরি করেছে।
এই গ্রামের মানুষ প্রথমেই অবাক হয় ২০০৬ সালে শকুনের মতো কিছু পাখিকে দেখতে পেয়ে। গ্রামের মোছা: রোকেয়া বেগম (৫৫) বলেন, “২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রাচীন শিমুল গাছে শকুনের মত বড় বড় ৪০-৫০ পাখি এসে বসল। আমরা প্রথমে এই পাখিকে চিনতে পারিনি, পড়ে জেনেছি যে এই পাখির নাম শামুখখোল। গ্রামের দুই পাশে দু’টি বিল থাকার কারনে ভালুকগাছী চকপাড়া গ্রামটিই পাখিগুলো হয়তো বসবাসের জন্য নির্বাচন করে নেয়।
মো: আব্দুল হামিদের (৭০) (একজন অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক) বলেন, “আমার শিমুল গাছেই প্রথমে পাখিগুলো বসে। সেখানেই আমার ৩ বিঘা জমির উপর আমের বাগান। আম বাগান ও শিমুল গাছ পাখির বাসস্থান উপযোগী হওয়ায় আস্তে আস্তে অনেক পাখি এসে বসবাস করে। পাশাপাশি খাদ্যর আধার ও সুপরিবেশ হওয়া সে বছর প্রচুর পরিমাণে শামুখখোল পাখি বংশবিস্তার করে।” তিনি প্রত্যক্ষ করেন এত জায়গা থাকতে পাখিগুলো তাঁর আশ্রয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বলে সেগুলোকে রক্ষা করার দায়িত্বও তার উপর বর্তায়।
কিন্তু কিছুদিন না যেতেই বিড়ম্বনা দেখা দেয়। স্থায়ী বসবাস শুরু করার কারণে পাখির বিষ্ঠায় গাছগুলোতে ফলন কমতে শুরু করে। এটা দেখে অনেকেই তাকে পাখিগুলোকে তাড়িয়ে দিতে বলেছে কিন্তু এসময়ের মধ্যেই তার পাখিগুলোর প্রতি মায়া পড়ে গেছে। তিনি সবসময়ই কোন পাখি শিকারীকে দেখলেই তাদের নিবারন করেন বা বুঝিয়ে বলেন পাখি শিকার না করতে।
শুধু মায়াই নয় আব্দুল হামিদ উপজেলা পর্যায়ে যোগাযোগ করে গ্রামটিতে পাখির অভয়াশ্রম ঘোষণা ও সাইনবোর্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং কি প্রতিবছর একবার করে সচেতনতামূলক মাইকিং এর ব্যবস্থা করেন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। পুঠিয়া উপজেলার বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন্যপ্রানী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, রাজশাহী বিভিন্ন সচেতনতা ও বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত আইন সম্বলিত সাইনবোর্ড দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। শুধু তাই নয় পাশাপাশি উপজেলা পরিষদ থেকে পাখি বসবাসকারী গাছগুলোর গোড়ায় কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে দিয়েছেন যাতে কেউ পাখিগুলোর বসবাসে কোন ধরনের সমস্যা না করতে পারে। তিনি নিজের উদ্যোগেই চকপাড়া গ্রামে ২০১৪ সালে আয়োজন করেন পাখি মেলার । পাখির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য মো. আব্দুল হামিদ ২০১৫ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের বঙ্গবন্ধু এ্যাওয়ার্ড -২০১৫ পদকে ভূষিত হন।
পাখিদের প্রতি একটি মানুষের ভালোবাসা সারা গ্রামকে পাখি গ্রাম হিসেবে সারাদেশে জাতীয় পুরূষ্কারে পাশাপাশি সন্মানের সাথে তুলে ধরেছে। এ গ্রামের মানুষ গর্ববোধ করেন। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষজন শুধু পাখি দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে ছুটে আসে এই গ্রামে । তাই ভালুকগাছী চকপাড়া পাখি প্রেমীদের কাছে পাখি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
স্থানীয় জনগণ জানান, বিল থেকে শামুখ, সাপ, সাপের বাচ্চা, ছোট মাছসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদই শামুখখোল পাখির প্রধান খাদ্য। শুকনা গাছের ডাল দিয়েই শামুকখোল বাসা তৈরি করে। চকপাড়া গ্রাম এখন সকলের দৃষ্টিতে একটি আদর্শ গ্রাম যেখানে মানুষ পাখিদের বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। এমন দায় আর দায়িত্ববোধ নিয়ে সকলেই প্রাণ-প্রকৃতির গান গাইবে এই প্রত্যাশা এই সকল নিবেদিত প্রাণ মানুষের।