বন্যা ভাবনা

কাজী সুফিয়া আখতার

বাংলাদেশ বন্যা প্রবণ দেশ। এই দেশে ফি বছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় হয়। আমরা বৃষ্টিতে ভিজি, রৌদ্রে পুড়ি, বন্যার পানিতে ভাসি এবং এভাবেই এদেশের প্রান্তিক মানুষেরা বেঁচে থাকি। বেড়ে উঠি। এবারের বন্যায় বাংলাদেশের ১৯টি জেলা প্লাবিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি বাঁধ ভেঙে রাতারাতি অনেকগুলো এলাকা বন্যা প্লাবিত হয়ে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। ১৯৮৮ সালের দীর্ঘস্থায়ী বড় বন্যার মতই এবছর তৃণমূল মানুষের, কৃষকের বিস্তর ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে;  ক্ষেতের ফসলের, গবাদি-পশু, ঘর-বাড়ি ও মৎস্য চাষের। বাঁধ ভেঙে রৌমারি পুরো এলাকা থৈ থৈ বন্যার পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। মানুষ তার নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরাতে পারেনি।  অনেক স্থানেই বন্যার পানিতে গ্রামের মানুষের নিরাপদ পানির একমাত্র ভরসা টিউবওয়েল ডুবে গেছে। মানুষ আশ্রয় নিয়েছে খোলা আকাশের নীচে, বাঁধের উপরে। নিরাপদ পানির অভাব, খাদ্য সংকট শুধু মানুষকে বিপর্যস্ত করেনি; গবাদি পশুর খাদ্য সংকটও কৃষককে চিন্তাগ্রস্ত করেছে। হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সবচে’ বেশি কষ্টে আছে গর্ভবতী নারী ও  শিশু। তাদের পুষ্টিকর খাবার দূরে থাক, নিয়মিত খাবারই জোটে না। বিশ্রাম, ঘুম কোনো কিছুরই ঠিক নেই। অধিকাংশ কমিউনিটি হেলথ সেন্টারগুলোতে বন্যার পানির কারণে যাওয়ার উপায় নেই। তাই আসন্ন সন্তান সম্ভবা মায়ের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। নবজাতক শিশু নিয়েও হরেক রকমের দুশ্চিন্তা। কখন না জানি ঠান্ডা লেগে যায়! বুকে কফ জমে। বৃদ্ধেরা চিড়া খেতে পারেন না। চিবুতে গেলে মাড়ি ব্যথা হয়ে যায়। ভাত রান্না করার খড়ি নাই। মানুষ এমন পরিস্থিতিতে কতভাবে কত না অসহায় হয়ে পড়ে!

13620293_138396663264016_3456395834856142590_n
রকমারি শস্যের বীজ বাঁচাতে পারেনি অধিকাংশ কৃষক পরিবার। সকল প্লাবিত এলাকায় পানির উচ্চতা ছিল বিগত কয়েক বছরের চেয়ে বেশি। এর কারণ হলো মানুষ তাদের চারপাশের অর্থাৎ রাস্তার পাশে মাঠের মাঝে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো ভরাট করে ফেলেছে। ফলে পানির উচ্চতা বেশি ছিল। টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোতে দেখা গেছে, ঘরের চালা ছুঁই ছুঁই পানি, উনুনে পানি, উঠোনে পানি। মাঠ, খাল, ডোবা, পুকুর কিছুই বোঝার উপায় নেই। চারদিকে ঘোলা পানির নাচন। কলা গাছের ভেলা বানিয়ে মানুষ একস্থান হতে অন্যতর স্থানে যাচ্ছে। আজকাল অতীত দিনের মত গ্রামের সকলের বাড়িতে কলা গাছও লাগানো হয় না। তাই কলা গাছের ভেলার সংখ্যাও কম। নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়াতে সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে আজ নৌকোও দেখা যায় না। উল্লেখিত সকল চিত্র আমাদের চেনা। তাহলে এই লেখার উদ্দেশ্য কি? কেন এই নিস্ফল প্রয়াস?

বাংলাদেশে বন্যা হয়,হবে এটা আমরা সকলেই জানি। তবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কি আমরা একটু সচেতন প্রয়াস গ্রহণে কমিয়ে আনতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি। শুধু দরকার উদ্যোগ গ্রহণের আন্তরিক সদিচ্ছা। প্রশ্ন হলো এক্ষেত্রে সরকার এবং জনগণ বন্যার পূর্বে কেন সচেতন উদ্যোগ গ্রহণ করে না? সমস্যাটা কোথায়? যে বাঁধগুলো ভেঙেছে সেগুলো নিয়মিত যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় নাই বলে অভিযোগ উঠেছে। এগুলো বন্যা পূর্ব সময় থেকেই না কি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। নদী ভাঙন রোধের জন্য বাঁধ নির্মাণ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি বড় ভূমিকা আছে। শোনা যায়, বাঁধ নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দরকার ,সে-পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয় না। আবার, বরাদ্দ ঠিক থাকলে প্রকল্প ফাইল বিভিন্ন টেবিল ঘুরে স্বাক্ষরিত হয়ে তা অনুমোদিত হয়ে আসতে আসতে বন্যা শুরু হয়ে যায়। পুরো প্রকল্পটাই নতুন করে গ্রহণ ও অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় পর্যবসিত হয়। এছাড়া এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সরকারি কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতির কথা তো সর্বজনবিদিত। প্রশ্ন রয়েছে তাদের সক্ষমতা নিয়েও। অনেক অভিজ্ঞজন মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। এটা আংশিক সত্য। এও সত্য যে, এ জন্য উন্নত দেশগুলো দায়ী হলেও তারা বাংলাদেশ সরকারের দাবি অনুসারে এ পর্যন্ত কোন ক্ষতিপূরণ দেয়নি। দেবেও না।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কয়েকবছর পূর্বে উন্নত দেশের চালকদের প্রতিশ্রুতি পালনে অনীহা দর্শনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিজেদের সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত সঠিক, আত্মসম্মানবোধ নিদের্শনা দিয়েছিলেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় নিজেদের অর্থায়নে, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ, যুক্তিসঙ্গত কৌশল ও যথাযথ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ প্রদানের কথা বলেছিলেন। তাঁর কথা অনুসারে আমরা যদি বন্যার পূর্বে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার অভিপ্রায়ে এবং সাধারণ মানুষ, গবাদি-পশু ও শিশু এবং নারীদের দুর্ভোগ-দুদর্শা হ্রাসে অংশগ্রহণমূলক বৈঠকের মাধ্যমে সম্ভবপর কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সচেষ্ট হই; আন্তরিক হই, তাহলে অবশ্যই এদেশের মানুষ বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।

happy wheels 2