আলোকিত পথে নয়, পথকে আলোকিত করে নারী
রাজশাহী থেকে ইসমত জেরিন::
একজন নারী প্রথমে মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে পরে নারী হয়ে উঠে। শৈশব থেকে কিছু বিশেষ্য ও বিশেষণ যুক্ত করার মধ্যে দিয়ে সে বেড়ে ওঠে। আবার বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে অর্পিত কিছু ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে একজন মানুষ নারীতে পরিণত হয়। এই পুরো ব্যাপারটিই হচ্ছে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। সামাজিকীকরণ এই প্রক্রিয়ায় মনের অজান্তেই একজন নারী ‘নারীতে’ পরিণত হয়ে উঠে যেখানে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অনেক অধিকার থেকে সে বঞ্চিত হয়। যখন নারী এই প্রক্রিয়ার প্রকৃতি উপলব্ধি করে এবং মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচিত করার স্বপ্ন সঞ্চার করে তখন তার সামনের পথকে অনেক বেশি অন্ধকারাচ্ছন ও বন্ধুর মনে হয়! কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাবানল তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় যে, সে একজন নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সামাজিক বেড়াজাল, ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক কিছু রীতিনীতি ও প্রথা নারীকে অধস্তন এবং অসম অবস্থায় দেখতেই বেশি পছন্দ করে। বারবার মনে করিয়ে দেয় যে, সামাজিক অধস্তন অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়াটাই নারীর ধর্ম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এতোসব প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও আমরা যুগে যুগে এমন কিছু সংগ্রামী নারী পেয়েছি যারা মনের অদম্য সাহস, শক্তি ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন পথকে আলোকিত করেছেন। কখনও ব্যক্তি উদ্যোগ আবার কখনও ব্যক্তি উদ্যোগকে সমন্বিত উদ্যোগে পরিণত করার মধ্য দিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির শৃঙ্খল ভেঙে নারী নতুন অগ্রযাত্রার পথ দেখিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন ‘মানুষ’ হিসেবে সমাজে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার!
উদাহরণস্বরূপ আমরা নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২), ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী নেত্রী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (১৯১১-১৯৩২), ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের যোদ্ধা কল্পনা দত্ত জোসি (১৯১৩-১৯৯৫), তেভাগা আন্দোলনের অগ্রদূত ইলা মিত্র (১৯২৫-২০০২), মণিপুরী ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগকারী বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী তরুণী সুদেষ্ণা সিংহ (১৯৬৪-১৯৯৬), পাহাড়ি আন্দোলনের প্রতীক কল্পনা চাকমাসহ নাম না জানা আরও অনেকেই। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে এসেও দৃশ্যতভাবে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অবস্থার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। আর অবস্থানের কথা বলতে গেলে নারীর অধিকার, স্বীকৃতি, মূল্যায়ন, মর্যাদাপ্রাপ্তি আগের যেকোন সময়ের তুলনায় পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেটা সার্বজনীন নয়, সমাজের সর্বস্তরে এই পরিবর্তন আসেনি। এর কারণ হলো এখনো সমাজের অধিকাংশ মানুষের মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি। ফলে নারীর অধিকারের প্রশ্নে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা এখনো নারীকে মানুষের স্বীকৃতি দিতে পারেনি। পরিবর্তনটা আগের সেই যৌতুক প্রথা যেমন আজ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিন্ম বিত্তের মানুষের কাছে উপহার হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তেমনি অতীতের মতো নারীর অবস্থানের পরিবর্তনের পথটির শুধু রূপ পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আজও নারীকে শোষণ, বঞ্চনা ও সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে। নারীর অবস্থানের পরিবর্তনের লক্ষ্যে অতীতের মহীয়সী নারীদের মতো আলোর দিশারী হয়ে তেমনি কিছু নারীদের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা তাদের ব্যক্তি উদ্যোগ ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে নতুন অগ্রযাত্রার সূচনা করেছেন।
সমাজে নারীর ক্ষমতায়নের পথকে আলোকিত করেছেন এবং নারী হিসেবে ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে আমরা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার হায়বাতপুর গ্রামের “বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক ২০১৪” প্রাপ্ত কৃষাণী ফরিদা পারভীন ও ধুমঘাট গ্রামের অল্পনা মিস্ত্রীর কথা স্মরণ করতে পারি যারা খাদ্য নিরাপত্তায় লোকায়ত জ্ঞানের প্রয়োগ ও স্থায়িত্বশীল চর্চার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং সমাজের মানুষের কাছ থেকে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। তাদের এই ব্যক্তিগত উদ্যোগকে প্রসারের জন্য নারী সংগঠনের মাধ্যমে সমন্বিত উদ্যোগে পরিণত করেছেন যাতে করে তাদের সমাজের নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠে এবং নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা পায়। এছাড়াও স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চার জন্য জেলা পর্যায়ে তারা শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরষ্কার লাভ করেছেন। তেমনিভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার সমাসপুর গ্রামের জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ “জয়িতা পদক ২০১৪” প্রাপ্ত নারী কবুলজানের কথা উল্লেখ করতে পারি যিনি পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন প্রকারের চুলা তৈরি করতে পারেন। তিনিও সমাজের নারীদের উন্নয়নের কথা ভেবে তার এই লোকায়ত জ্ঞানকে অন্য নারীদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেছেন। তবে নারী হওয়ার কারণে এসব কাজে কবুলজানের পরিবারের প্রধানের প্রথমত সম্মতি ছিল না। কিন্তু জয়িতা পুরুষ্কার পাওয়ার পর কবুলজানের পরিবারে তার অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে এবং কাজের মূল্যায়ন করা হচ্ছে অর্থাৎ কবুলজানের উদ্যোগের পথটা আলোকিত ছিল না কিন্তু সে তার মনের নিজস্ব আলোয় আলোকিত করে নিয়েছেন। কবুলজানের মতে,“আমি চাই প্রত্যেক নারী যেন সমাজে অধিকার পায় এবং মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে”।
অর্থাৎ উপরোক্ত গ্রামীণ নারীদের একটাই স্বপ্ন সমাজে নারীর যেন ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা হয় এবং সর্বক্ষেত্রে নারীকে যেন মানুষ হিসেবে প্রকৃত মর্যাদা দেওয়া হয়। পথকে আলোকিত করার নারীদের এই প্রয়াসে বারসিক সহায়কের ভূমিকা পালন করে আসছে। এর কারণ হলো গ্রামীণ নারীর উন্নয়নের স্বপ্ন এবং বারসিকের স্বপ্ন একই। বারসিকের জননেতৃত্বে উন্নয়ন প্রক্রিয়া উন্নয়নের নতুন কোনো পদ্ধতি নয়। গ্রামীণ মানুষের উন্নয়নের বিরাজমান দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে নেতৃত্ব দেয় জনগণ। গ্রামীণ নারীরাও তেমনি সংগঠিত হয়ে সমন্বিত উদ্যোগের দ্বারা একে অন্যের সমস্যার সমাধান করে, সক্ষমতা প্রসারের চেষ্টা করে যার নেতৃত্বে থাকে নারী। নারীদের যেমন স্বপ্ন সমাজে সকল নারী যেন তার কাজের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি পায়, নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা পায় এবং সর্বোপরি নারী যেন একজন মানুষ হিসেবে গণ্য হতে পারে তেমনি বারসিক অর্থাৎ আমাদেরও স্বপ্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবস্থানের পরিবর্তন হবে এবং নারীর অবস্থানের কথা বিবেচনায় রেখে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নারী ভূমিকা পালন করবে। নারীদের এই সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথকে আলোকিত করার সংগ্রামে বারসিকের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।