নদী সংহতি: রক্ষা করুন বরেন্দ্র অঞ্চলের নদী ও খাড়ি
রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমাওে, বলো কোথায় তোমার দেশ, তোমার নেই কি চলার শেষ’-হেমন্ত মুখার্জির এই গানে বোঝা যায়, নদীর গতি প্রকৃতি, নদীর সাথে মানুষের সম্পর্ক, নদীর সাথে বসতির সম্পর্ক, নদী সম্পর্কে মানুষের আবেগ ও ভালোবাসা। আবার বোঝা যায়, নদী নিয়ে অভিমান। একটি দেশ বা অঞ্চলের জন্য নদী কতটা গুরুত্ব বহন করে তা আমরা এ গানেই দেখতে পাব। নদী যতই একুল ভাঙ্গুক না কেন নদী পাড়ের বসতি ও মানুষের কাছে পবিত্র আবার আবেগের জায়গাতেই থাকে। এখানে একটি কথা উল্লেখ করার মতো ২০১৩ সালের দিকে কাজের সুত্রে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কালাসোনা চরের মানুষের সাথে বেশ সখ্যতা তৈরি হয়েছিলো।
কালাসোনা চরটি ছিলো প্রায় ৭০-৮০ বছরের পুরানো। তখন বক্ষ্রপুত্র নদের ভাঙ্গনে প্রতিবছর কালোসোনা চরের মানুষের ক্ষতি হতে দেখেছি। মানুষ আবার পুনরায় ঘর বেঁধেছে সেই নদীর পাড়েই। তখন কালাসোনা চরের মোঃ সোহরাব হোসেনের কাছে প্রশ্ন করি, ‘আপনারা বারবার নদী ভাঙ্গনের শিকার হোন আবার নদী পাড়েই কেন বসতি গড়েন কেন? তিনি তখন বলেছিলেন “নদী ছাড়া আমরা কি বাঁচতে পারব, সকালে উঠে নদীর পাড় না এলে আমাদের সারাদিন ভালো যায় না।’ আসলে এ কথার গুরুত্ব অনেক। সোহরাব হোসেনের কথায় বোঝা যায়, নদী আমাদের বাঁচার কত বড় অনুষঙ্গ। নদী নিয়ে অনেক গান, কবিতা ও গল্প আছে, যা জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
একটি দেশের জন্য যেমন নদী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তেমন একটি অঞ্চলের জন্যও নদী সমান গুরুত্বপূর্ণ। আজকের আমাদের প্রসঙ্গ বরেন্দ্র অঞ্চলের নদী। আমরা সবাই অবগত যে, বরেন্দ্র অঞ্চল অত্যন্ত খরা ও পানি সংকটাপন্ন অঞ্চল। পানির জন্য এখানে যেমন সামাজিক অনুষ্ঠানের তারিখের পরিবর্তন করতে হয় তেমনই আবার খাবার পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে নারীদের সাথে ঘটে অনাকাংখিত ঘটনা। পানি নিয়ে এরকম হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে এ অঞ্চলে। পাশাপাশি এক সাথে চলছে নদী, খাল ও খাড়ি দখল দূষণ, ভরাট করে মেরে ফেলার মহোৎসব। আর এই কারণে এ অঞ্চলের খাড়িগুলো আজ মরে গেছে। বর্ষা ছাড়া খাড়িতে সারাবছর পানি থাকে না। নদীগুলোও মৃতপ্রায়! শহরের বর্জ্য ফেলা, নদী পাড়ের জমিগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত বিষ প্রয়োগের কারণে নদীর প্রাণবৈচিত্র্যও আজ হুমকির মুখে। বিলুপ্ত হয়েছে অনেক দেশি জাতের মাছ, পাখি, সাপ, ব্যাঙ। আরো অনেক প্রজাতি আজ বিলুপ্তির পথে।
বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহী উপজেলার একমাত্র নদী শিব নদী। এ নদীর উৎস্যমুখে বাঁধ দেওয়া ও নদী দখল দূষণের কারণে নদী আজ নালায় পরিণত হয়েছে। এখন শিব নদীতে আর সারাবছর পানি থাকে না। পাওয়া যায় না বৈচিত্র্যময় মাছ। শিব নদীর মতোই আত্রাই, মহানন্দা, বারনই, পদ্মা, পূর্নভবা, জোয়াখালি খাড়ি, নারদ, বড়াল, নন্দকুজা নদীগুলো আজ নিজের স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় আজ তাদের নিঃশ^াস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তাই নদী সংহতির মাধ্যমে নদী, খাল ও খাড়ির কষ্টগুলোর কথা সবার সামনে উপস্থাপনের জন্য এ অঞ্চলের সকল নদীগুলো (প্রতীকী অর্থে) শিব নদী পাড়ে মিলিত হয়েছিলো। সব নদীগুলো প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে নিজেদের কষ্টের কথা সকলের মাঝে উপস্থাপন করেন। ব্যতিক্রমি এ উদ্যোগে বারসিক’র সাথে সারথী ছিলেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোকুল-মোথুরা গ্রামের স্বপ্নচারী যুব সংগঠনের সদস্যরা। এ বিষয়ে সংগঠনটির সভাপতি মোাঃ রুবেল হোসেন মিন্টু (৩৬) বলেন, ‘আমাদের গ্রামরে পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে শিব নদী। নানা কারণে আজ নদীটি মৃতপ্রায়। তাই আমরা বরেন্দ্র অঞ্চলের সকল নদীর নাম ও সমস্যাগুলো সবার সামনে উপস্থাপনের জন্য এই “নদী সংহতির” আয়োজন করেছি। যা সকল পর্যায়ের মানুষকে সচেতন করবে।’
বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি সমস্যা সমাধানের জন্য এ অঞ্চলের নদীগুলো সুরক্ষা করার কোন বিকল্প নেই। নদী সংহতি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন গোকুল-মোথুরা গ্রামের শ্রী বরেন্দ্রনাথ সূত্রধর (৮৪)। তিনি বলেন, ‘আমাদের শিব নদী দিয়ে একসময় বড় বড় নৌকা চলত, ছিলো না রংয়ের পাল তোলা নৌকা। অনেক প্রজাতির মাছ পেতাম আমরা। আজ এগুলোর কিছু নেই। নদী খনন হলে আবার এখানে সারাবছর পানি থাকবে।’ তিনি নদী খননের দাবি জানান।
বরেন্দ্র অঞ্চলের নদী গুলো সুরক্ষা করার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠ পরিকল্পনার। পাশাপাশি নদী দূষনের হাত থেকে রক্ষা করতে সকলের সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। প্রয়োজন সকলের ঐক্যবদ্ধ কর্ম প্রচেষ্টা।