নারীর ব্যয় সাশ্রয়ী ভূমিকা ও একটি স্থানীয় চর্চা
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
একজন কৃষকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না ই থাকতে পারে কিন্তু মানুষ হিসেবে তাঁর মৌলিক বুদ্ধিবৃত্তি এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান রয়েছে। সেই জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই কৃষকগণ নিজেদের সামর্থ্যকে আবিষ্কার করেন। তাঁদের প্রতিদিনের জীবনযাপন, কৃষিচর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে মাটি, পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করে চলেছেন।
আমাদের দেশের কৃষকদের অনেক ব্যতিক্রমী, নিজস্ব চাষাবাদ পদ্ধতি রয়েছে। যে সকল পদ্ধতি ব্যবহার করে তাঁরা স্থায়িত্বশীল কৃষিকাজ করে যাচ্ছেন। সাধারণত কৃষক বলতে আমাদের চোখের সামনে একজন পুরুষের ছবিই ভেসে উঠে। কিন্তু একজন নারীও যে তাঁর সৃষ্টিশীলতা আর মেধা দিয়ে কৃষিকাজে ব্যয়সাশ্রয়ী ভূমিকা পালন করে আসছেন, মালা আক্তার অন্যতম উদাহরণ।
কৃষাণী মালা আক্তার সবজি চাষের সাথে যুক্ত ছেলেবেলা থেকেই। তাঁর বাবা কৃষিকাজ করতেন। কৃষক পরিবারে বেড়ে উঠা মালার বিয়েও হয় একজন কৃষকের সাথে। স্বামীর সাথে কৃষিকাজে তিনি সহযোগিতা করতেন। তাঁর স্বামী গত বছর দেশের বাইরে কাজ করতে চলে যান। স্বামীর অনুপস্থিতিতে বর্তমানে তিনি নিজ বাড়ির আঙিনায় কৃষি কাজ শুরু করেছেন। সংসারের কাজ করার পর বাকি সময়টুকু তিনি সবজির জমিতেই কাটিয়ে থাকেন। কখনো জমি পরিষ্কার, মরিচ বা টমেটো গাছে খুঁটি দেয়া, বীজ রোপণ ইত্যাদি কাজ তিনি খুব মনোযোগ সহকারেই করে থাকেন। এই কাজে একদিকে যেমন পরিবারের সবজির চাহিদা পূরণ হয় তেমনি কিছু সবজি বিক্রি করে বাড়তি রোজগারও হয়।
ছোট্ট একখণ্ড জমি আছে মালা আক্তারের। কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে জমি তৈরি করেন। সেই জমিতে মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, আলুসহ নানা ধরণের সবজি চাষ করেন তিনি। এই এলাকায় আলুবীজ রোপণের পর খড় দিয়ে ঢেকে দেন যাতে অতিরিক্ত কুয়াশায় ফসল নষ্ট না হয়ে যায় এবং জমিতে সেচ কম দিতে হয়। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বিগত দুই বছর যাবৎ কৃষাণী মালা আক্তার রসুন চাষ করে আসছেন। এটা অবশ্য তাঁর নিজস্ব পদ্ধতি, যা নিজের অজান্তেই কার্যকর পদ্ধতিতে রূপ নিয়েছে। কারণ আলু ছাড়া অন্য কোনো ফসলে এই পদ্ধতিতে কেউ চাষ করেনা।
একই জমিতে তিনি পাশাপাশি আলু, রসুন, মরিচ ইত্যাদি চাষ করেন। গত বছর আলু চাষের জমিতে খড় বিছিয়ে দেয়ার পর বাড়তি খড়গুলো তিনি রসুনের জায়গায় দিয়ে রাখেন। জমিতে সেচ দেয়ার সময় হলে তিনি দেখেন জমির মাটি ভেজা আছে। তাছাড়া কোনো ঘাসও নেই জমিতে। এটা দেখে তিনি পুরো জমিতে খড় বিছিয়ে দেন। এভাবেই জমিতে রসুন বাড়তে থাকে।
নেত্রকোণা এলাকায় কৃষকরা সাধারণত কার্ত্তিক/অগ্রহায়ণ মাসে রসুনের বীজ রোপণ করে থাকেন। কৃষকের ভাষায় চিকনা (বেলে দোআঁশ) মাটিতে রসুন চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। রসুন চাষে তেমন কোনো পরিশ্রম নেই। গোবর দিয়ে জমি প্রস্তুত করে বীজ রোপণ করতে হয়। তারপর আর কোনো কাজ নেই। রসুন গাছে তেমন কোনো পোকার আক্রমণ হয়না তাই কীটনাশকও দিতে হয়না। জমির মাটি যদি শুকনো থাকে তবে মাঝে মাঝে অল্প সেচ দিতে হয়। ঘাস গজালে পরিষ্কার করতে হয়। চৈত্র মাসের দিকে রসুন বড় হলে গাছগুলো শুকিয়ে ঢলে পড়ে যায়। তখন রসুন সংগ্রহ করতে হয়।
আমাদের দেশে গতানুগতিকভাবে কৃষকরা এভাবেই রসুন চাষ করেন। কিন্তু মালা আক্তার তাঁর এই পদ্ধতিতে রসুন চাষ করে বেশ উপকৃত হয়েছেন। জমিতে খড় বিছিয়ে দেয়ার ফলে মাটি ভেজা থাকে। জমিতে সেচ দিতে হয়নি। জমিতে আগাছা জন্মায়নি তাই পরিষ্কারের জন্য সময়, অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। এই পদ্ধতির আরো সুবিধা হলো মাটি/গাছের গোড়া খড় দিয়ে ঢাকা থাকে বলে কুয়াশা বেশি হলে ফসলের কোনো ক্ষতি হয়না। গাছগুলো পুষ্ট ও লম্বা হয়। তাছাড়া রসুন বাড়ে দ্রুত এবং কোয়াগুলো বেশ বড় হয়। রসুন নষ্ট হয় কম, দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। যে সকল জমিতে সেচ দেয়ার সুবিধা নেই সে সকল জমিতে এই পদ্ধতিতে ফসল চাষ করলে একদিকে যেমন ব্যয় সাশ্রয় হয়, তেমনি অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির সীমিত ব্যবহার হয়।
মালা আক্তারের রসুন চাষের পদ্ধতি দেখে তাঁর দুইজন প্রতিবেশি এবছর এইভাবে চাষ করেছেন। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী গ্রামের একজন কৃষক এই পদ্ধতিতে রসুন চাষ করেছেন।
একজন পুরুষ ইচ্ছে করলে সময়মতো কাজ করতেও পারেন আবার নাও পারেন। কিন্তু নারীরা তা পারেন না। তাঁদের কাজ নিত্যদিনের, চলমান। নিজস্ব বুদ্ধি দিয়ে, প্রকৃতিকে ব্যবহার করে তাঁরা যেমন সংসার পরিচালনা করে থাকেন, তেমনি কৃষিকাজেও প্রাকৃতিক উপাদানকে সংরক্ষণ করেন। তাঁদের চর্চায় প্রকৃতি বা পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়না। তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হওয়া যায়।