দুবইল থেকে সাহপুর : মুসুর ডালের যাত্রা
রাজশাহী তানোর থেকে অমৃত সরকার
একসময় বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা ধানের পাশাপাশি ডাল ও তেল জাতীয় শস্যের চাষ করতেন। এসব ফসলে পানি সেচের তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু ভুল উন্নয়ন উদ্যোগ অব্যহত প্রচারনায় ক্রমশ হারিয়ে গেছে এখানকার ঐতিহ্যগত চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় ফসলের জাত ও বিভিন্ন ধরণের শস্য-ফসলের চাষাবাদ। যার অনিবার্য ফলস্বরূপ বর্তমানে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে পানি সংকট। এত প্রতিকূলতার র মধ্যেও আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন কিছু কৃষক যারা নিজেদের প্রচেষ্টায় টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন শস্য-ফসলের জাত ও বরেন্দ্র’র প্রাণ-প্রকৃতিকে। এমনি এক সফল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের দুবইল গ্রামের কৃষকেরা। সেচসাশ্রয়ী মসুর ডাল চাষাবাদ ও ফসলটির সম্প্রসারণ উদ্যোগ আজ উৎসাহী করে তুলছে আশেপাশের গ্রামের কৃষকদেরও।
বিগত ২০১৪ সালের রবি মৌসুমে দুবইল গ্রামের চার জন কৃষক মোঃ হযরত আলী (৫০), মোঃ লিয়াকত আলী (৪২), মোঃ শফিকুল ইসলাম(৪৫), ও মোঃ রমজান আলী (৪৫) পাশ্ববর্তী নাচোল উপজেলার বরেন্দ্রা গ্রামে যান সেখানকার কৃষকরা রবি মৌসুমে কি ধরনের ফসল চাষবাদ করেন তা সরেজমিনে দেখবার জন্য। কৃষকরা বরেন্দ্রা গ্রামের কৃষকদের বোরো ধানের পরিবর্তে মসুর চাষাবাদে কম সেচ ও তুলনামূলক লাভ দেখে নিজেরাও আগ্রহী হন এবং পরবর্তী মৌসুম নিজেদের গ্রামে চাষাবাদের জন্য দশ কেজি মসুর বীজের সংগ্রহের কথা জানান। ২০১৫ সালের রবি মৌসুমে দশ কেজি বীজ সহযোগিতা নিয়ে দুবইল গ্রামের মোঃ লিয়াকত আলী ও মোঃ রমজান আলী নিজেদের ২বিঘা জমিতে প্রথমবারের মতো মসুর মসুর চাষ করেন। মোঃ লিয়াকত আলীর ১বিঘা জমিতে সাড়ে চার মণ ফলন হয় এবং মোঃ রমজান আলীর এক বিঘা জমিতে ফলন হয় সাড়ে তিন মণ। বোরো ধানের চেয়ে মসুর চাষে উৎপাদন খরচ কম হওয়ার কারণে গ্রামের অনেকেই পরবর্তী বছরে মসুর চাষ করার আগ্রহী হন। এ প্রসঙ্গে মোঃ লিয়াকত আলী বলেন “প্রথম বছর আমি বিশ কেজি খাওয়ার জন্য এবং বিশ কেজি বীজ হিসাবে ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়ে বাকী সব মসুর বীজ হিসাবে অন্য কৃষকের কাছে বিক্রয় করেছি। সব খরচ বাদ দিয়ে আমার লাভ হয়েছিল ৫৫০০/-টাকা । পাশাপাশি মোঃ রমজান আলী লাভ করেন ৪০০০/-টাকা। মোঃ রমজান আলী বলেন “মসুর চাষে উৎপাদন খরচ অনেক কম, পানি সেচও কম দিতে হয়। মসুর খুব অল্প সময়ে ফলন দেয়। তবে আমার অনভিজ্ঞতার কারণে ঐবছর ফলন একটু কম হয়েছিল। মসুর ফসলটির চাষাবাদ সে সময়ই দুবইল গ্রামে কৃষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। এলাকায় নতুন ফসল মসুর চাষ প্রসঙ্গে মোঃ জাহেদুল ইসলাম (৪৭) বলেন “আমাদের এলাকায় ফসল ফসল চাষে সেচ একটি বড় সমস্যা। শুধু ধান ও আলু চাষের ফলে এ সমস্যা দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে। মসুর চাষে পানির প্রয়োজন কম বলে আমাদের এলাকার জন্য এটি অবশ্যই ভালো ফল বয়ে নিয়ে আসবে”।
এরই ধারাবাহিকতায় দুবইল গ্রামে ২০১৬ সালের রবি মৌসুমে ২০জন কৃষক ৩৫ বিঘা জমিতে মসুর চাষ করেন। এবছরই প্রথমবার মসুর চাষ করেছেন মোঃ লিয়াকত আলী বলেন “গত বছর আমি প্রথম মসুর চাষ দেখি এবং এর চাষ পদ্ধতি, ফলন ও বাজার মূল্য সব বিবেচনা করে আমার কাছে মনে হয়েছে এই ফসল আমাদের এলাকা উপযোগি হবে। কারণ বোর ধান করলে আমাদের পানির জন্য খুব কষ্ট করতে হয়। কিন্তু মসুর চাষ খুবই সহজ এবং সময়ও কম লাগে। তাই ৩ বিঘা জমিতে মসুর লাগিয়েছিলাম। ১৭ মন মসুর পেয়েছি”। একই গ্রামের মোঃ মোস্তফা কামাল, মোঃ মুজাহারুল ইসলাম, মোঃ রফিকুল ইসলাম ও একই মতামত দেন।
দুবইল গ্রামের কৃষকদের মসুর চাষে অনুপ্রাণিত হয়ে পাশ্ববর্তী সাহপুর গ্রামের ৩ জন কৃষক প্রথমবারের মত ১১ বিঘা জমিতে মসুর চাষ করেছেন। ঐ গ্রামের কৃষক মোঃ শফিকুল ইসলাম (৫০) বলেন “আমাদের গ্রামে বিগত বছর গুলোতে ধান ও আলু ছাড়া অন্য ফসল চাষ হত না। আবার ধান চাষে প্রচুর পরিমাণে পানি সেচের প্রয়োজন হয় এবং সময় মত পানি পাওয়া যায় না। আমি দুবইল গ্রামে মসুর চাষ দেখে ও চাষ পদ্ধতি শুনে নিজের ২বিঘা জমিতে মসুর চাষ করেছি”। একই গ্রামের অপর দুইজন কৃষক মোঃ নাসির হোসেন ও মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেন “ মাটির নিচে পানি না থাকলে সেচের পানির সংকট হবে এটাই স্বাভাবিক, মসুর চাষে পানির কম প্রয়োজন হয় ও চাষ খরচ খুবই কম তাই আমরা মসুর চাষ করেছি।
বরেন্দ্র এলাকার সেচ সংকটের প্রেক্ষিতে আগামী রবি মৌসুমে দুবইল,শাহপুর ও সংলগ্ন গ্রামগুলোতে মসুর চাষ ব্যপকভাবে বিস্তার লাভ করবে এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে এমনটিই জানা যায়।