মনে পড়ে সেই সব দিনের কথা
সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
‘আগে আমাদের এলাকায় এমন কোন বাড়ি ছিলো না যে বাড়িতে কোন না কোন গবাদি পশু পালন হতো। আর এ গবাদি পশু পালনের সাথে সাথে আমরা ছিলাম রোগ শোক মুক্ত। তখন রোগবালাই কম হতো মানুষসহ সকল প্রাণীর। আর এখন প্রত্যেক ঘরে যেন রোগ বাসা বাঁধছে। আমরা আগে গরু, মহিস এর দুধ, দুধ দিয়ে তৈরি মাখন, ঘি, ছানা ও ঘোল খেতাম। হাস-মুরগির ডিম ও মাংস খেতাম যাতে কোনরকম সার-কীটনাশকমুক্ত। আগে সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখতাম রাখালেরা গরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে, নারীরা গবাদি পশু-পাখি গোয়াল থেকে বের করে, গোয়াল ঘর পরিস্কার করে। গাভী দোহন করা, গবাদি পশু-পাখির খাদ্য দেওয়া যেন নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য ছিলো তখন। আমাদের এলাকার চারিদিকে যেন গৃহপালিত প্রাণীর গন্ধ, তাদের ডাক, তাদের ভালোবাসা, তাদের সাথে সময় দেওয়া যেন এক ভিন্ন জগতে বসবাস করার শামিল। তবে সেই সুদিন আর নেই এখন। সেই দিনগুলোর কথা বড্ড মনে পড়ে।’
উপরোক্ত এমন কথাগুলো বলেন ইশ্বকরীপুর ইউনিয়নের গুমানতলী গ্রামের কৃষানী নুরনাহার বেগম। গতকাল বারসিক’র সহায়তায় জাওয়াখালী কৃষি নারী সংগঠনের উদ্যোগে ইশ^রীপুর ইউনিয়নের গুমানতলী গ্রামে কৃষাণী মর্জিনা বেগমের বাড়িতে এলাকায় ‘প্রাণী সম্পদের উপর লবণাক্ততার প্রভাব’ বিষয়ক গ্রাম পর্যায়ে আলোচনা সভায় এ কথাগুলো বলেন তিনি।
আলোচনা সভায় জাওয়াখালী ও গুমানতলী গ্রামের কৃষক, কৃষাণী, শিক্ষার্থী বারসিক’র বিশ্বজিৎ মন্ডল ও বিধান মধুসহ মোট ২৬ জন অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে এলাকার প্রাণী সম্পদের বর্তমান ও অতীত অবস্থা, চারণভূমির বর্তমান ও অতীত পরিস্থিতি এবং উৎপাদনের তুলনামূলক চিত্র নিয়ে জানতে চাওয়া হয়।
সভায় অংশগ্রহণকারীরা জানান, প্রাণী সম্পদ আগের তুলনায় এখন কমে গেছে। এখন প্রত্যেক বাড়িতে শুধু হাঁস-মুরগি, ছাগল বেশি কিন্তু আগে ছিল গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, হাঁসের মধ্যে ছিল (রাজ হাস, পাতি হাস, মেরি হাস), মুরগির মধ্যে ছিল (গলাছেলা, পায়রা, পা খাটো, কাজলী, ঝুটো বাধা), টিটি, টার্কি। তারা আরও জানান, বাড়িতে পোষা হতো ঘুঘু, ময়না, বক, শালিক, টিয়া, কোয়েল, মাছরাঙা ইত্যাদি। আগে এ সকল প্রাণীর চারণভূমি ছিলো উন্মুক্ত। আর এখন এসব প্রাণীসম্পদ বদ্ধভাবে পালন করা হয়। আগের তুলনায় এখন গবাদী প্রাণীর পালনের খরচও বেশি। অনেক দূর থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়। খাবারের স্বাদ নেই, মুখে যেন অরুচি। এছাড়া রোগবালাই বেশি হচ্ছে। হঠাৎ করে বাড়ির সব প্রাণী মারা যাচ্ছে। সাথে উৎপাদন ও কমে যাচ্ছে (ডিম, মাংস,দুধ)।
তাঁরা আরও জানান, প্রাণীর আয়ুস্কালও কমে যাচ্ছে। প্রজননও সময় মতো হচ্ছে না। যেমন আগে গরু বছরে বাচ্চা হতো আর এখন দেড় থেকে দু’বছর লেগে যাচ্ছে, ডিম আগে মাসে ২০টির উপরে পাওয়া যেতো আর এখন সর্ব্বোচ ১৫টি হচ্ছে। শুধুমাত্র প্রাণী সম্পদের সমস্যা হচ্ছে না, সাথে সাথে মানুষের নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। যেমন জ¦ালানী খরচ বেড়ে গেছে, বাজার থেকে রাসায়নিক সার কীটনাশক ক্রয় করতে হচ্ছে, জৈব সারের ঘাটতি, পুষ্টিকর খাবার না পাওয়া, আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া, বাইরের কাজে বিশেষ করে ভাটায় যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। আর এসব সমস্যা হওয়ার প্রধান কারণ হলো লবণাক্ততা। কারণ যেদিন থেকে এলাকায় লবণ পানি উঠিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে সেদিনের পর থেকে এ সমস্যা বেড়েই যাচ্ছে। লবণ পানির কারণে গবাদি প্রাণী পালন করতে পারছেন না কেউ কেউ। তাছাড়া গবাদী প্রাণীর বিচরণের জায়গাও কমে গেছে। যার কারণে এলাকা থেকে প্রাণী সম্পদ কমতে শুরু করেছে।
অংশগ্রহণকারী ৬ষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী বিল্লাল হোসেন বলে, ‘আমি আমার বাবা, মা, দাদা, দাদির কাছে শুনেছি আগে অনেক ধরনের প্রাণী ছিল আমাদের এলাকায় তবে এখন তা কমে গেছে। আগের মানষেরা ভালো ছিলো তাদের মন মানসিকতাও ভালো ছিলো। তারা পুষ্টিকর খাবার খেতো। বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি ছিল যেমন বিভিন্ন অনুষ্ঠান মোড়ক লড়াই, ষাড়ের যুদ্ধ, ঘোড়া ছুটসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান। আর এখন ছোট বড় সবাই মোবাইল ও টিভি দেখে সময় কাটায়। যার জন্য মন-মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে।’
অংশগ্রহণকারীরা লবণাক্ততার প্রভাব থেকে প্রাণী সম্পদ রক্ষার জন্য নিজেরা বিভিন্ন ধরনের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা আরো ভালোভাবে করার জন্য কিছু সুপারিশ ও পরামর্শ প্রদান করা হয় আলোচনায়। তারা মনে করেন রোগবালাই সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তারা প্রাণী সম্পদ পালনের প্রশিক্ষণ সহায়তা, লোনা ঘাস কেটে এনে তা মিষ্টি পানি দিয়ে ধুয়ে ব্যবহার, এলাকা উপযোগী ঘাস লাগানো ঘেরের রাস্তা ও বসতভিটায়, সুপেয় পানির পুকুর খনন, পিএসএফ এবং টিউবওয়েল স্থাপনের দাবি জানান।