প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যের প্রতীক সুনন্দ প্রজাপতি

::দেবদাস মজুমদার,বিশেষ প্রতিনিধি,উপকূল অঞ্চল

প্রজাপতিপ্রজাপতি নানা রঙে তড়বড়িয়ে উড়ে, মধু ভরা জংলী ফুলে বাগান খানি জুড়ে। সুনন্দ বর্ণিল প্রজাপতি নিয়ে কাব্য সাহিত্যে আছে নানা বর্ননা। আমাদের প্রাণ প্রকৃতির অনুসঙ্গ এ প্রজাপতি মায়াবি মুগ্ধ পতঙ্গ প্রাণ। প্রজাপতি নামক পতঙ্গটি নিসর্গের অলংকার স্বরূপ।

প্রজাপতি বৃত্তান্ত

প্রজাপতি প্রাণীজগতের Arthropoda পর্বের Insecta শ্রেণীর Lepidoptera বর্গের অন্তর্গত একটি পতঙ্গ। এদের দেহ-মাথা, বক্ষ ও উদর এই তিন খন্ডে বিভক্ত। মাথার ওপরের দিকে এক জোড়া করে এন্টনা, পুঞ্জাক্ষী, পাল্প ও একটি নলাকার প্রবোসসি থাকে। প্রবোসসি দিয়ে খাদ্য হিসেবে তারা ফুল থেকে ফুলে মধু সংগ্রহ করে । দুই জোড়া রঙিন পাখনা ও দেহের সংযোগস্থল বক্ষ এবং উদরের শেষে দুই বা তিন খন্ডে প্রজাপতির যৌনাঙ্গ থাকে। পাল্প ছাড়াও বিস্ময়কর সংবেদনী অঙ্গ হিসেবে কাজ করে এদের পা। পায়ের শেষ খন্ডে কমোরেসপ্টিরে থাকে যা কোন বস্তুকে স্পর্শ করে এর স্বাদ বুঝতে সাহায্য করে। প্রবোসিসের সাহায্যে খাদ্য হিসেবে ফুলের মধু গ্রহণ করে। তবে পুরুষ প্রজাপতি ভেজা মাটি, অতিরিক্ত পাকা ফল কিংবা পচাগলা জৈব পদার্থ থেকে পানি ও খনিজ লবণ সংগ্রহ করে থাকে। এই ঘটনাকে Puddling বলা হয়।

সারা পৃথিবীতে প্রজাপতির রাজ্যে প্রায় ১৮ হাজার প্রজাতির অস্তিত্ব রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৩২৬টি প্রজাতির প্রজাপতির সন্ধান মিলেছে। যদিও এর সংখ্যা ৫০০ এর নিচে হবার কথা নয়। কার্যকর গবেষণা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমাদের সঠিক সংখ্যাটি এখনও জানার বাইরে থেকে গেছে ।

প্রজাপতি প্রাণ যে শুধু তার সৌন্দর্য দিয়েই আমাদের মন আনন্দে ভরে দেয় না। এর অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রয়েছে। যেমন প্রজাপতি ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে, অন্যের খাদ্য হিসাবে খাদ্য শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজাপতি পাহাড়ি এলাকায় গুল্ম জাতীয় গাছের সময়মত পরাগায়ন ঘটিয়ে বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল হতে পাহাড়কে ধসের হাত থেকে রক্ষা করে । প্রজাপতির সাথে গাছপালার একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। গাছপালার বংশ বিস্তারের জন্য যেমন পরাগায়ন দরকার হয় তেমনি প্রজাপতির জীবনচক্রে গাছপালার একটা বড় ভূমিকা আছে। প্রথমত একটি প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতি একটি নির্দিষ্ট গাছে ডিম দেয় এবং এই ডিম থেকে শুটকীট বরে হয়ে এই গাছের পাতা খেয়ে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদে ডিম পাড়ে। শুটকীট ধীরে ধীরে বড় হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। গাছের একটি শক্ত ডালের সাথে নিজেকে আটকে রেখে চারদিকে একটি শক্ত আবরণ তৈরী করে। যাকে ‘পিউপা’ বলা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর পিউপা ভেঙে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি প্রকৃতিতে মুক্ত ভাবে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়।

বাংলাদেশে অবস্থান  

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রজাপতির প্রজাতি বৈচিত্র্যতা দেখা যায় উত্তরপূর্ব এবং দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা গহীন বনে। উত্তরপূর্ব অঞ্চলে বেশ কিছু প্রাকৃতিক বন যেমন লাওয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমাকেলেঙ্গা জাতীয় উদ্যানে দেখা মেলে বাহারি প্রজাপতির। এছাড়াও বেশ কিছু সংরক্ষিত বনে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি সন্ধান মেলে। দক্ষিণপূর্ব কাপ্তাই, কর্ণফুলি, দুধপুকুরিয়া জাতীয় উদ্যান,বান্দরবনের কেওকাড়াডাং, লামা, থানচিতে আছে বৈচিত্র্যময় প্রজাপতি।এছাড়া ঢাকা মিরপুরের জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেনে রয়েছে কয়েক প্রজাতির প্রজাপতি। এই উদ্যানে প্রায় ১৩৩ প্রজাতির প্রজাপতির বিচরণ। IUCN এর সহায়তায় বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রজাপতির প্রজাতি পরিচিতি জানতে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ নেন বিখ্যাত লেপিডপ্টেরেস্ট Torben B. Larsen । ২০০৪ সালে প্রকাশতি Butterflies of Bangladesh- an notated checklist বইয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রজাপতি নিয়ে বিশদ বিবরণ তুলে ধরেছেন।

 প্রজাপতি ২ প্রজাপতি প্রকৃতিক স্বাস্থ্যের প্রতীক

প্রজাপতির জীবন চক্রের প্রতিটি  ধাপে পরিবেশের বিশেষ প্রভাব লক্ষ্যণীয়। এজন্য প্রজাপতিকে পরিবেশের বায়ো ইন্ডিকেটর (Bio Indicator) বলা হয়। পরিবেশগত বিভিন্ন গবেষণায় প্রজাপতিকে একটি একক হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া আমাদের পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত মুক্ত প্রজাপতি উদ্যান প্রতিষ্ঠা করে প্রজাপতি সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশে পর্যটন ব্যবসার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। সচেতনতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাংলাদেশের কিছু প্রজাপতির প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। এর  মূল কারণ মূলত নির্দিষ্ট প্রজাতির লাভার (প্রজাপতির কীট অবস্থা) খাদ্যের যোগানকারী নির্দিষ্ট গাছের অভাব, নির্বিচারে বন উজার করে বাসস্থান তৈরি, বনের ওপর মানুষের দৌরাত্ম ও ধংসের আগ্রাসন, শিল্পায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অসচেতনতা এবং অপরিকল্পিতভাবে কীটনাশক ব্যবহারে পতঙ্গনাশ । প্রজাপতি সবচেয়ে সফল পরাগায়ণকারী হিসেবে পরিচিত। আর এজন্য প্রজাপতি পরিবেশের প্রাকৃতিক  স্বাস্থ্যেরে প্রতীক। পৃথিবীর সকল প্রাণীই খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। তাই মানুষের জীবনপ্রবাহের জন্যই প্রজাপতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা ও আলোকচিত্রী হাসান মাসুদ বলেন, মানুষের জীবন ও জীবিকাকে বাঁচাতে প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা করা অতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রজাপতি আমাদের নিসর্গের শুধু সৌন্দর্য বাড়ায় না নিসর্গের বিস্তার ঘটায়। প্রজাপতি আমাদের প্রাণ প্রকৃতি থেকে হারাতে বসেছে। প্রজাপতি সুরক্ষায় দলবদ্ধ কিছু মানুষ বিজ্ঞানভিত্তিক “বাটারফ্লাই বাংলাদেশ” নামে একটি সংগঠন কাজ করছে। প্রজাপতি সুরক্ষায় এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। আশার কথা এই এ গ্রুপের উদ্যোগে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে পাঁচ দিন ব্যাপী আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

প্রজাপতি নিয়ে দিনের আলোকচিত্র প্রদর্শনী

বাংলাদেশে প্রজাপতি নিয়ে মেলা বা আলোকচিত্র প্রদর্শণী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়মিত হয়ে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে এতবড় পরিসরে আলোকচিত্র প্রদর্শণী এযাবৎ হয়নি। তবে আশার কথা “প্রজাপতি বাংলাদেশ” এবার দেশে প্রথম বড় পরিসরে প্রজাপতি নিয়ে আলোচিত্র প্রদর্শণীর আয়োজন করে। ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জাতীয় জাদুঘর গ্যালারীতে পাঁচ  দিন ব্যাপী এ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রজাপতি প্রাণ সুরক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এ আয়োজন করেছিল “বাটারফ্লাই বাংলাদেশ” নামে সংগঠনটি। সারাদেশে প্রকৃতিপ্রেমী আলোকচিত্র গ্রাহকরা এ প্রদর্শনীর জন্য ছবি জমা দেন। বাছাই শেষে ৯২ জন আলোকচিত্রীর ছবি চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয় আয়োজক কর্তৃপক্ষ । প্রায় দেড় শতাধিক প্রজাপতির ছবি এ প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়। এছাড়া প্রাণ ও পরিবেশ বিষয়ক প্রকাশিত বই, পোস্টারও এ প্রদর্শনীতে স্থান পায়। শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভাসহ প্রজাপতি নিয়ে ছিল নানা আয়োজন। জাতীয় জাদুঘর এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

happy wheels 2

Comments