আলোকিত সমাজ গড়াই নাসরিনের স্বপ্ন
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন
বাংলাদেশে শিক্ষার হার এখনো কম। কেউ কেবলমাত্র অক্ষরজ্ঞান-সাক্ষরতা নিয়েই জীবন পরিচালনা করেন। সম্প্রতি দেশে নারী শিক্ষার হার বাড়লেও এখনো গ্রামে গঞ্জে হাজারো নারী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু আমরা জানি শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। কিন্তু এই মেরুদন্ডে মাঝে মাঝেই আঘাত এসে পড়ে। মূলভূমি হরিরামপুর উপজেলা থেকে এ ঘণ্টা নৌকা যোগে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে পায়ে হেটে পাড়ি জমাতে হয় লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে নটাখোলা গ্রামে। সেই গ্রামের সংগ্রামী নারী নাসরিনের কথাই বলছি। মাত্র অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর একই গ্রামের জসিম উদ্দিনের সাথে বাবা মা বিয়ে দিয়ে দেয়। ফলে জীবনে নেমে আসে বিভীষিকা। কিন্তু থেমে থাকেননি নাসরিনের জীবন সংগ্রাম। নিজের তাগিদেই গড়ে তুলেছেন স্কুল। সেই স্কুল এখন ওই গ্রামের একমাত্র স্কুল যা প্রতিনিয়ত আলো ছড়াচ্ছে।
নাসরিন বলেন, “বিয়ের পরও আমার পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ কমেনি। তাই নিজের তাগিদে গ্রামের ৫ জন ছাত্র সংগ্রহ করে তাদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করি। শুরুতে কেউ উৎসাহ না দিলেও আমি শক্তি হারায়নি। আস্তে আস্তে প্রাইভেটে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একসময় আমি আমার উঠোনে জায়গা দিতে পারতাম না।”
নাসরিন জানান, তার স্বামী কৃষি কাজ করতেন। কিন্তু একজনের আয় দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করা কঠিন ছিল। তাই তিনি এই পেশা বেছে নেন। পরবর্তীতে তার স্বামী এই কাজে তাকে সহযোগিতাই করেছেন। তিনি বলেন, “যখন আমি আর জায়গা দিতে পারতেছিলাম না তখন এলাকার মানুষ জনের পরামর্শ নিয়ে একটি স্কুল করার সিদ্ধান্ত নিই। ২০১৩ সালে সকলের সহযোগিতায় একটি ঘর নির্মাণ করি । স্কুলের নাম দেই নটাখোলা আদর্শ কিন্ডার গার্টেন। বর্তমানে স্কুলটিতে প্রথম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ১২০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে।”
এলাকার মানুষজনের সাথে কথা বলা জানা যায়, চরাঞ্চলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর চেয়ে তুলনামুলকভাবে নাসরিনের নিকট যে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়েছে তাদের ফলাফল সন্তোষজনক। ফলাফল ভালো করাই শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও দিনদিন বাড়ছেই। তার এই উদ্যোগে এলাকার সকল মানুষ খুবই খুশি । তারা প্রত্যাশা করেন যে স্কুলটি দ্রুতই জাতীয়করণ হবে।
ইতিমধ্যে নাসরিনের স্বামী বিদেশে পাড়ি জমান, সংসারের অভাব অনটন কমতে থাকে। অন্যদিকে স্কুলে সামান্য আয়ে তাদের পরিবার স্বচ্ছলভাবে চলছে । নাসরিন খাতুন বলেন, “টাকা পয়সার প্রতি আমার আর লোভ নাই, আলোকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যেই স্কুল করেছি।” ভবিষ্যত পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চাইলে নাসরিন আরও বলেন, “এলাকার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ এবং সমাজ সেবক ব্যক্তিদের হাতে স্কুলটি ছেড়ে দিতে চাই। যাতে স্কুলের লেখাপড়ার মান আরও ভালো হয়, পাশাপাশি সরকারিকরণের ইচ্ছাও রয়েছে।”
বর্তমানে স্কুলটি উপজেলা শিক্ষা অফিসের আওতায় রেজিষ্টেশন পেয়েছে। শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে প্রশ্ন পত্র, বই, শিক্ষা উপকরণ (ফ্লিপচার্ট, অক্ষর শিক্ষার চার্ট, ছবিযুক্ত ক্যালেন্ডার), শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে মনিটরিং ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।
উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার নায়েব আলী বলেন, “বেসরকারিভাবে চরাঞ্চলে যে সকল শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, ঝরে পড়া রোধে তারা অবদান রাখছে, তাদের আমরা সহযোগিতা করছি এবং ভবিষ্যৎ এ এই সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে”।
এখন গ্রামের সকলের স্বপ্ন এই স্কুলটি একদিন অনেক বড় হবে, সুনাম বৃদ্ধি পাবে।