জীবন্ত বেড়া ও সৌন্দর্য বিস্তারে ফাল্গুনী মালঞ্চি বৃক্ষ
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ ও গবাদি পশুপাখি পালন করে। গ্রামের মানুষ বেশিভাগ ক্ষেত্রে তাদের বসতঘরে ও ভিটার চারপাশে এগুলো পালন ও চাষ করেন। বাড়ির পাশে ফসলের ক্ষেত ও গবাদি পশুপাখি পালনের ফলে এসব পশুপাখি সুযোগ পেলেই চাষকৃত ফসল খেয়ে নষ্ট করে। গবাদি পশুপাখির হাত থেকে ফসল রক্ষায় কৃষকরা তাই জমির চারপাশ বেড়া দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ এসব বেড়া সাময়িক সময়ের জন্য আবার কেউ কেউ স্থায়ীভাবে দিয়ে থাকেন। সাময়িক সময়ের জন্য বেড়া তৈরির ক্ষেত্রে বাঁশ বা যেকোন ধরণের গাছের ডাল ব্যবহার করা হয়। তবে স্থায়ীভাবে জীবন্ত বেড়া দেয়ার ক্ষেত্রে যেসব গাছের ডাল পুঁতে দিলেই গাছ হয় এমন গাছের ডাল ব্যবহার করা হয়। জীবন্ত বেড়ার জন্য ব্যবহৃত হয় এমন গাছের প্রজাতির মধ্যে জিকা, শিমূল, তুঁত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব প্রজাতির গাছ এখন বিলুপ্তির পথে। অন্যদিকে জিকা, শিমূল ইত্যাদি গাছ অনেক বড় হওয়ায় এক পর্যায়ে গিয়ে জমিতে ছায়া তৈরি করে এবং জমির রস শুষে জমির ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে বিধায় এগুলোর ব্যবহার অনেকগুণে হ্রাস পেয়েছে।
ফসলের জমিতে স্থায়ীভাবে জীবন্ত বেড়া দেয়ার ক্ষেতে আজ থেকে অনেক বছর পূর্বে মধুপুর অঞ্চলে (ফরেস্ট এলাকা) আগমন হয় ‘ফাল্গুনী মালঞ্চি’ নামের বহুগুণ সম্পন্ন একটি বিদেশী প্রজাতির বৃক্ষের, যা Gliricidia নামেও পরিচিত। ইন্টারনেট ঘেটে দেখা যায়, গাছটির পুরো নাম Gliricidia sepium. মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, সেন্ট্রাল আমেরিকা ও ভারতসহ প্রায় সত্তোরটিরও অধিক দেশে এটি জন্মে। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে এ বৃক্ষের আগমন ঘটে আজ থেকে প্রায় শত বছরেরও অধিক আগে। মূলত ব্রিটিশ শাসনকালে চা বাগান এলাকায় চা গাছের জন্য ছায়া তৈরির উদ্দেশ্যে সেন্ট্রাল আমেরিকা ও ভারত থেকে Gliricidia sepium গাছ নিয়ে আসা হয়। পূর্ণ বয়স্ক একটি গাছ ১২-১৫ মিটার পর্যন্ত উচ্চতার হয়ে থাকে। সরু ও লম্বা অসংখ্য ডাল বিশিষ্ট গাছের পুরোটা জুড়েই পাতা থাকে। পাতা অনেকটা দেশী অরবরই এর পাতার মত দেখালেও পাতাগুলো অনেক পুরু ও কিছুটা পিচ্ছিল। ডালগুলো সরু ও লম্বা হওয়ায় গাছের নিচে শীতল ছায়া সৃষ্টি হয়। আর এজন্যই হয়তো চা বাগানে ছায়া গাছ হিসেবে এটি রোপণ করা হতো।
বীজ থেকে এবং ডাল থেকে ফাল্গুনী মালঞ্চি বৃক্ষের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে এই বৃক্ষটি চা বাগান এলাকাও বিরল হয়ে গেছে। বর্তমানে মধুপুর অঞ্চলে গবাদি পশুপাখি থেকে আনারস ফসল রক্ষার জন্য বাগানের জীবন্ত বেড়া দেয়া হয় এ গাছের ডাল দিয়ে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে গাছের সমস্ত পাতা ঝড়ে যায় এবং মার্চ মাসের শুরুতে পাতাবিহীন ডালে হাল্কা গোলাপী রঙ এর ফুলে গোট ডাল ঢেকে যায়। গোটা গাছটি অপরূপ সাজে সজ্জিত থাকে। মৌমাছি, প্রজাপতিসহ মধুকরি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও কীটপতঙ্গের গুনগুন শব্দে গাছের চারপাশ মূখরিত হয়ে থাকে। এ গাছের ফুলে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও যুবরাসহ সকল বয়সের মানুষ আকৃষ্ট হয়ে সেলফি তোলে মূহুর্তগুলো স্মৃতি করে রাখে।
ফাল্গুনী মালঞ্চি গাছ বহুবিধ গুণে সমৃদ্ধ। এর ফুল মানুষ খাদ্য, পাতা ও ফুল গবাদি পশুর খাদ্য, এর পাতা জমিতে নাইট্রোজেন যুক্ত করে মটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, এর ফুল মধু উৎপাদনের জন্য খুবই উৎকৃষ্ট, জ্বালানি ও কাঠের যোগান দেয়, পাতা দিয়ে ফসলের বালাইনাশক তৈরি, ফাংগালের প্রতিরোধক তৈরি, বেদনানাশক তৈরি, পুঁজ নিরাময়, ব্রুণ ও ফোড়া নিরাময়, শরীরের অংশ থেঁতলে যাওয়া, জ্বালাপোড়া, ঠান্ডা, কফ, জ্বর, হাড়ভাঙ্গা, ঘা, মাথা ব্যথা, চুলকানি, ঘামাচি, বাতরোগ, চামড়ার টিউমার, আলসার, আঘাত ইত্যাদি থেকে উপশম পাওয়া যায়। এছাড়াও মাটির ক্ষয় রোধ, বাগানের বেড়া দেয়া, জমিতে আগাছা জন্মানো রোধ করে, ফসলে ছায়া সৃষ্টি, ফসলে মালচিং দেয়া, সবুজ সার তৈরি ও খুটা হিসেবে ব্যবহারে এ গাছের জুড়ি নেই।
এ গাছটি ডাল ও বীজ থেকে সহজেই জম্মায় তাই এর বিস্তার ঘাটানো খুবই সহজ। ডাল থেকে এর বংশ বিস্তারের জন্য এপ্রিল-মে মাসে এর ডাল কেটে রোপণ করতে হয়। এ গাছের ডাল দীর্ঘ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকে, তাই মে মাসের দিকে প্রথম বৃষ্টি পেলেই সেখান থেকে কুশি বের হয়ে গাছে পরিণত হয়। এ গাছের দ্বারা অন্য কোন গাছের কোন ক্ষতি যেমন হয়না, তেমনি এটি প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশবান্ধব। তাই জমির ফসল রক্ষায় জমির চারদিকে বেড়া দেয়া, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি, ফসল ও মানুষের বিভিন্ন রোগ বালাই নিরাময়, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং গো-খাদ্য ও জ্বালানির চাহিদা পূরণে ফাল্গুনী মালঞ্চি গাছ রোপণ উৎকৃষ্ট।