মানুষ গাছ দিয়েই আমারে চিনুক আর কিছু চাইনা
মানিকগঞ্জ থেকে ঘুরে এসে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
নাম তার ইব্রাহীম মিয়া (৭০)। বাড়ি ভেদাভাঙ্গা নয়াবাড়ি, সিংগাইর, মানিকগঞ্জ। “৯ ভাই বোন নিয়ে আমাদের ছিল অভাবের সংসার। আব্বা একা একা কাজ করতেন। বর্ষাকালে ধান কাটলে আমাদের এলাকায় টুরা ধান হতো। আমরা ছোট বেলা থেকেই সেই টুরা ধান ধুকাইয়া ভাত খাইতাম। অনেক সময় পানির মধ্যে হাটতে হাটতে পায়ে ঘা হইয়া যাইতো, সে এক ভয়াবহ কষ্টের দিন ছিল রে ভাই।” কথাগুলো বলছিলেন ইব্রাহীম মিয়া।
তিনি বলেন, “একসময় আমরাও স্বচ্ছল ছিলাম কিন্তু ধলেশ্বরীর কড়াল গ্রাসে আমাদের ঘর বাড়ি-জায়গা-জমি নদী গর্ভে চলে যায়। বাবারা ৪ ভাই ছিলেন। সবাই আলাদা আলাদা হয়ে গেল আর শুরু হলো আমাদের অভাবের সংসার। আর সেই ১১ বছর বয়স থেকেই আমার টুরা ধান টুকানো শুরু।”
তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তান আমলে সেই বয়সে আমি পাতার বিড়ি বান্ধিতাম ৪ আনা করে। পরে দুই হাজার বিড়ি বান্ধিলে ২ টাকা করে দিত। আইয়ুব সরকারের আমলে বিড়ি বান্ধা বন্ধ করে দিল-আমি আবার বেকার হয়ে গেলাম। এরপর প্রায় ১৮/১৯ বছর ইট ভাটায় কাজ করলাম।” ইব্রাহীম মিয়া বলেন, “হঠাৎ গন্ডগোল (মুক্তিযুদ্ধ) শুরু হয়ে গেল। তখন আমার বয়স ২৬ বছর। কাজের জন্য তখন যশোর থাকি। আমার দুই কাজের সাথী জয়নাল আর মুসার পরামর্শে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক ঘটনার কথা মনে পড়ে। যশোরের জেলখানা ভেঙ্গে তাদেরকে মুক্ত করে আমরা তাদের দলভূক্ত করেছিলাম। এরপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি-সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি-আহতও হয়েছি।”
তিনি বলেন, “ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমি কখনো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথার্থ সম্মান, এমনকি সার্টিফিকেট পাইনি। মুক্তিযুদ্ধের পর একটি কার্ড দিয়েছিল কিন্তু তা পুড়ে যায়। পরবর্তীতে ৩-৪ বার আবেদন করেছি কোনবারই পাইনি-টাকা চেয়েছে কিন্তু আমি টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনতে চাই না। আমাদের এলাকায় এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা ৩-৪ লাখ টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়েছে। আমার সার্টিফিকেটের দরকার নাই।”
দেশ স্বাধীন হবার পর ইব্রাহীম বিভিন্ন কোম্পানির সাথে কনস্টাকসনের কাজে অংশগ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে ভাগ্যের খুজে দীর্ঘ ৬ বছর ইরাক ও সৌদি আরবে যান। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র ৪ বছর পর বাবা আমার হঠাৎ করেই মারা যান। বাবা মারা যাবার সময় বলে যান “এতোদিন তোমার ভাই বোনদের রিজিক আমি দেখেছি এখন এগুলো তোমাকেই দেখতে হবে খোদার নামে।” এরপর ৮ ভাইবোনকে নিয়ে শুরু হয় নতুন জীবন সংগ্রাম । একের পর এক ৫ বোনকে বিয়ে দেয়া, ভাইদের পড়াশুনা করানো, নিজের বিয়ে, সংসার সবই তাকে একাই করতে হয়েছে।
এসব কিছুর মাঝেও তিনি কৃষি কাজ ও উদ্ভিদ প্রেম বাদ দেননি। তিনি বলেন, “ আমি জীবনভর বৃক্ষ প্রেমী হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিয়ে থাকি। রাতদিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কৃষি কাজ করেছি আর যখনই কোন গাছের সন্ধান পেয়েছি ছুটে গেছি সেখানেই। আমার বাড়িতে বর্তমানে প্রায় ৮০-৯০ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ আছে”। ইব্রাহীম মিয়ার সংগ্রহে আছে ৪০ এরও অধিক ফলের গাছ যেমন: আম, কাঁঠাল, সুপারি, নারিকেল, লেবু, আমলকি, জাম্বুরা, আমড়া, ছবেদা, কমলা, পেয়ারা, বড়ই, অরবড়ই, জামরুল, পিচফল, ডৌয়া, কামরাংগা, বেদানা, মেওয়াফল, লটকন, কদবেল, চালতা, বিলাতি গাব, জলপাই। আর ঔষধি গাছের মধ্যে আছে উলট কমল, ঘৃতকমল, মুরমুরে, কল্পনাথ, গোড়া চক্কর, রাধা চক্কর, সাদা লজ্জাপতি, মনিরাজ, পাথর চুনা, মানরাজ, শতমুল, বাসক, রামতুলশি, কাল তুলশি, বায়না, ইশ্বর মুল, তুলশি, জৈষ্ঠমধু, টাকা থানকুন, ভুইকুমরা, তুরুক চন্ডাল, বিষজারুল ইত্যাদি। এছাড়া অচাষকৃত উদ্ভিদের কোন হিসাব নাই। তিনি বলেন, “আমি কখনই কোন গাছ নষ্ট করিনা। কোন একটা গাছ নষ্ট হলে মনে হয় আমার কোন সন্তান আহত হয়েছে। আমি নিজেই এই সকল উদ্ভিদের পরিচর্চা করি নিজ হাতে। একটা গাছের জন্য এমনকি এমনিতেও আমি মাইলের পর মাইল হাটতে পারি আর এতে আমার কোন ক্লান্তি নাই।”
ইব্রাহীমের দাদা, বাবা থেকে শুরু করে কবিরাজি তাদের পারিবারিক পেশা কিন্তু তা কোন অর্থের বিনিময়ে না। প্রতিমাসেই প্রায় ২০-৩০ জন মানুষ আসে নানান ধরণের সমস্যা নিয়ে। ভেষজ গাছ-গাছন্ত দিয়েই চিকিৎসা করা হয় । এদের অনেকেই সুফল পায়-আবার আসে। তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী পারিবারিকভাবে ভাদ্রমাসে ভেলাভাসানো উৎসব (ঔরস) হয়। উৎসবে গান,বাজনা, খাওয়া -দাওয়া সহ বিশাল আয়োজন হয়। উৎসবে যে যা পারে তাই দিয়ে সহযোগিতা করেন।
তিনি বলেন, “আমাদের সমাজে হাজারো ধান্দাবাজ মানুষ আছে। আমি কোন ধান্দার ধার ধারিনা। আমি হেঁটে হেঁটে দূর দূরান্তে যাই টাকা বাঁচানোর জন্য না। আমার লক্ষ্য থাকে গাছের দিকে। যে গাছটা নতুন দেখি সেট্ইা আমার বাড়িতে এনে লাগাই। আমার বাড়িতে এখন পর্যন্ত ১৩০ টি মত গাছ আছে। তবে শুধু মাত্র কাঠ হয় এমন গাছ আমি খুব একটা লাগাই না।” তিনি বলেন, “ আপনারা সবাই শুনেছেন ‘সবুরে মেওয়া ফলে’ আমি সেই মেওয়া ফলের গাছও সংগ্রহ করে লাগিয়েছি। এমন অসংখ্য গাছ আমি দেশের নানান প্রান্ত থেকে লাগিয়েছি। ফুলের বাগানেও প্রায় ২০ ধরণের ফুল গাছ রয়েছে। কারো পূজার জন্য, কোন অনুষ্ঠানে বা যেকোন প্রয়োজনে গ্রামের মানুষ ফুল নেয়-আমার কোন আপত্তি নেই।” ইব্রাহীম মিয়া তার বাগানের সবজিতে কখনই কোন রাসায়নিক বা বিষ প্রয়োগ করেন না। যে কারণে তাঁর যেকোন সবজি তিনি বাজারে ওঠানের আগেই রাস্তাতেই শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, “আমি চেষ্টা করি মানুষকে বিষমুক্ত খাদ্য ও সবজি খাওয়ানোর। যে কারণে সকলেই আমাকে বিশ্বাস করে খাদ্য ও ভেষজ নিয়ে। গ্রামে কারো জন্ডিস বা জ্বর বা অন্য যেকোন সমস্যা হলেই আমার কাছে ছুটে আসে আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করি।”
এই পড়ন্ত জীবনে আপনার কি প্রত্যাশা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি এখনো সুস্থ সবল আর কাজ করে খাই । মানুষ আমার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে এটাই আমার প্রাপ্তি আর আমাকে গাছ দিয়েই মানুষ চিনুক এটাই আমি চাই। আমার সন্তানরা যদি আমার এই কাজ ধরে নাও রাখে মানুষ নিশ্চয়ই ধরে রাখবে সেটাই আমার শান্তি।”
একজন ইব্রাহীম মিয়া জীবনের শেষ বেলায় এসেও তার উদ্যম আর আগ্রহে গড়ে তুলেছেন একটি দৃষ্টিনন্দন খামার বাড়ি। যেখানে গাছপালা, তরুলতা, ভেষজ আর নানান অচাষকৃত উদ্ভিদের সমাহার। এক কথায় চোখ জুড়িয়ে যায় সেই বাড়ির দিকে তাকালে। তার স্বপ্ন এই বাড়ি কেবল নয়; প্রতিটি বাড়িই এভাবে নিজেদের বৃক্ষপ্রেমী আর ভেষজ উদ্ভিদের খামারে পরিণত হবে। বারসিক পরিবারের পক্ষ থেকে সবুজ মানুষটির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর সম্মান।