প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়ছে

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা:
প্রকৃতিনির্ভর একটি দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষের প্রতিটি কাজ ও কাজের সমাধান এক সময় প্রকৃতির কাছ থেকেই খুঁজে নিতো। তবে আধুনিকতায় নিবিষ্ট হওয়ার কারণে প্রকৃতির উপাদানের ব্যবহার কমে গেছে এবং প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে গুরুত্ব না দিয়ে মানুষ এসব উপাদানের যত্ন বা পরিচর্যা নেয় না। ফলশ্রুতিতে প্রকৃতির অসংখ্য উপকারি উপাদানগুলো দিনকে দিন ধ্বংস হচ্ছে। প্রকৃতির প্রতি বিমুখ হওয়ার কারণে মানুষ বর্তমানে নানান জটিলতার সন্মূখীন হচ্ছে। একসময় মানুষ বাজার নির্ভরশীলতা কম ছিলো, বাজারের সংখ্যাও কম ছিলো। নেত্রকোনা সদরে মাত্র দু’টি বাজার ছিলো। সবচে’ বড় বাজারটি ছিলো মাছের বাজার। সপ্তাহে ২দিন হাট বসতো: শনিবার ও মঙ্গলবার। জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ ওই দু’দিনে হাটে আসতেন মাছ কেনার জন্য বা বিক্রি করার জন্য।
তখন বাজার ছিলো পারস্পারিক তথ্য বিনিময়ের কেন্দ্র, যার মাধ্যমে পারস্পারিক উন্নয়ন ও সম্পর্ক তৈরি হতো। অতীতে হাটবারে যে পরিমাণ লোকজন আসতো বর্তমানে একটি বড় মেলা হলেও সেই পরিমাণ লোকজন দেখা যায় না। বর্তমানে বাজার আর নির্দিষ্ট জায়গায় বসে না; যেখানে সেখানে এখন বাজার দেখা যায়। প্রতিদিনই মানুষ বাজার করছেন তবে আগের মতো সবার সাথে মিলেমিশে, তথ্যবিনিময় কওে কিংবা পারস্পারিক আলোচনা আর হয় না। নিজের প্রয়োজন কেনার পর যে যার মতো তাদের গন্তব্যে চলে যান। মানুষ আজ খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মানুষ সবচে’ বেশি বাজারে আসেন ওষুধপত্র কেনার জন্য। এর অর্থ হলো অতীতের তুলনায় বর্তমানে রোগের আক্রমণ বেড়েছে।
তবে করোনা পরিস্থিতি চিত্রটা কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে। কারণ বর্তমানে মানুষ আবারও প্রকৃতিনির্ভর হতে শুরু করেছে। তাদের বাড়ির চারপাশের বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছালি বা অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের মাত্রা বাড়িয়েছেন। জ্বর হলে প্যারাসিটামল আনার জন্য বাজারে না গিয়ে জ্বর কমানোর জন্য তারা বাড়িতেই প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান থেকে ওষুধ তৈরি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিশ্বনাথপুর গ্রামের শারমিন। তিনি তাঁর সন্তানের জ্বর হলে চিরতা, সুনাপাতা ও আমলকি একসাথে জাল দিয়ে তাদের খাওয়াচ্ছেন জ্বর সারার জন্য। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়মিত সকালে চিরতার তিতা খেলে জ্বর হয় না। আমার ছোট্টবেলা থেকেই নিয়মিত খেতাম। এজন্য রোগে আক্রান্ত হতাম কম। বর্তমানে করোনার কারণে বাজারে কম যাওয়া হচ্ছে। তাই তাই বাড়িতে তৈরি করে আমি আমার সন্তানদের খাওয়াচ্ছি। ফলও কিন্তু পাচ্ছি।’ একই গ্রামের প্রিয়া বলেন, ‘এখন বর্ষা মৌসুম। নদীর পাড়ে এখন এলঞ্চি শাক পাওয়া যায়। এলঞ্চি শাক শুকতানি রান্না করে খেলে পেটের সমস্যা দূর হয়। রুচিও বাড়ে।’ অন্যদিকে আমতরা কুমারপাড়ার নারী নিশা রাণী বলেন, ‘আমাদের পাড়ার শিশুদের জ্বর, সর্দি কম হয়। কারণ আমরা প্রতিদিন শিশুদের শরীরে সরিষার তেল দিয়ে রোদ লাগাই। এতে করে শিশুদের হাড় শক্ত হয়। সৈলপুর গ্রামের জেলে পাড়ার হৃদয় রবিদাস বলেন, ‘আমরা সারাদিন পানিতে থাকি। তাই জ্বর ও সর্দির ভয় থাকে সবসময়। তবে আমরা সারাবছর আদা, এলাচি ও লবঙ্গ দিয়ে চা খাই। জ্বর হলে আমরা জ্বর কমানোর জন্য পদ্ম এলঞ্চি ভিজিয়ে নিয়মিত খাই। এতে করে আমরা জ¦র থেকে আরোগ্য লাভ করি।’
অন্যদিকে রেল কলোনির মঞ্জু মিয়া একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। রেল কলোনিতে বসবাস করলেও তিনি প্রকৃতির বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থেকে নানান ধরনের ওষুধ তৈরিতে বেশ অভিজ্ঞা। এই করোনা পরিস্থিতিতে রেল কলোনি ছাড়াও নানান এলাকা থেকে মানুষ তাঁর কাছে ছুটে আসেন জটিল সমস্যা নিয়ে। বিশেষ করে জন্ডিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বেশি আসেন। তিনি শারীরিক দুর্বলতা দূর করার জন্য অর্জুন গাছের ছাল ও দুধ দিয়ে মিশে নিয়মিত খাওয়ার পরামর্শ দেন।
করোনা পরিস্থিতিতে বাজারে যাওয়া কমে গেছে শহর ও গ্রামের মানুষের। তাঁরা পরিবারের প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেন বিভিন্ন ধরনের ভেষজ উপাদানের গুণাবলী, যা প্রকৃতি থেকেই পাওয়া যায়। এতে করে পরিবারের শিশু, কিশোর-কিশোরীরাও জেনে নেয় প্রকৃতির গুণাবলী। এ সম্পর্কে কিশোরী স্বর্ণা আক্তার বলে, ‘ করোনার কারণে অনেক রোগের ওষুধি গাছ চিনলাম। ভবিষ্যতে আমাদের কাজে লাগবে।’ চলতি বছরে অনেক কিশোর-কিশোরী নিজের বাড়িতে নিম, তুলসী চালতা ইত্যাদি গাছ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে।’
আমাদের সকল সমস্যা সমাধান আমরা প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পাই। তাই প্রকৃতিকে ভালো রাখার দায়-দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সবার।

happy wheels 2

Comments