শহরের সবুজ ঘাসে বস্তির নাদিরার স্বপ্ন
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
একপাল ভেড়ার পাশ দিয়ে প্রবীণ নারীটি এক’পা দু পা করে হাঁটছে। একা নিঃসঙ্গ নয় তিনি। তার চারপাশের একপাল ভেড়া তাকে পাহাড়া দিচ্ছে। আবার সেই ভেড়াগুলোরও যেন নিরাপত্তার দায়িত্বে তিনি। হাতে একটি লাঠি। কখনো সবুজ ঘাসে বসছেন। আবার ইট সরিয়ে দিয়ে সবুজ ঘাসের ডগা বের করে দিচ্ছেন ভেড়ার মুখে। মধ্যাহ্ন সূর্যের তাপে যেন কপাল পুড়ে যাচ্ছে প্রবীন সেই নারীর। তবুও মুখে স্বপ্নসাধের গুমোট হাসি। কোন ক্লান্তি নেই। বলছিলাম রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ২৬ নং ওয়ার্ডের নামোভদ্রা বস্তির নাদিরা বেগমের (৬০) কথা।
দীর্ঘ উনিশ বছর আগে নাদিরার স্বামী মারা গেছে। অনেক ছোট থাকতেই নাদিরা তার পরিবারের সাথে অভাবের কারনে রাজশাহী শহরে পাড়ি জমিয়েছিলেন। মানুষের বাসা বাড়িতে কাজ করতে করতে একসময় বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর সাথে সংসার। কিন্তু অভাব তাকে কখনই ছাড়েনি। স্বামীর মৃত্যর পর পরিবারের তিন সদস্যের সংসার নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। কিন্তু তার মনের শক্তি আর চেতনা তাকে হারতে দেয়নি। শুরু হয় জীবন সংগ্রামের আরেক অধ্যায়। একজন সহৃদয়বান লোকের সহযোগিতায় একটি ভ্যান ক্রয় করে নিজে ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতে শুরু করেন। পাশাপাশি ঝুট কুড়িয়েও বাড়তি আয় করতেন। কিন্তু এক বর্ষার বিকালে ঝুট কুড়াতে ড্রেনে পড়ে গিয়ে ডান হাত ভেঙ্গে যায়, সাথে শরীরর ডান অংশ অবস হয়ে যায়। নিজের সংগৃহিত টাকা এবং অন্যের সহযোগিতায় সেরে উঠেন বটে; কিন্তু সম্পুর্ণ সুস্থ্য হয়ে উঠতে পারেননি। তবুও দমে যাননি নাদিরা। শহরের আনাচে কানাচে সবুজ ঘাসগুলোর দিকে নজর পড়ে নাদিরার। সবুজ ঘাসগুলোই যেন নাদিরার আরেক স্বপ্ন জাগিয়ে দেয়। মনে হলো এই ঘাসগুলোও তার সম্বল ও স্বপ্নের সাথি হতে পারে। তিনি মনে করলেন ভেড়া কিনবেন। কারণ ভেড়ারর খাবারের সমস্যা হবে না। নাদিরা ভ্যান চালিয়ে তিন হাজার টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। বাজারে গিয়ে তিন হাজার টাকায় দুটো ভেড়া কিনে আনেন। শুরু হয় নাদিরার ভেড়া পালন। সেই দশ বছর আগের কথা। দিনে দিনে ভেড়া বাড়তে শুরু করে। তিনি ভেড়া বিক্রি করে সংসারের খরচ চালাতে থাকেন। বর্তমান তার পালের মধ্যে মোট বিশটি ভেড়া। নিজস্ব জায়গা না থাকায় বস্তির একটি খুপড়িতেই ভেড়া এবং নিজে একসাথে থাকেন। নাদিরা বলেন, “রাজশাহী শহরে এখনো অনেক ফাকা জায়গা আছে, সেগুলোতে সবুজ ঘাস জন্মে, আমার ভেড়া সেই ঘাস খেয়ে থাকে।” তিনি আরো বলেন, “খাবারে তেমন খরচ নেই, তবে মাঝে মাঝে ভাইরাস জনিত কারণে ভেড়ার রোগ দেখা দেয়। তখন তিনি প্রাণী সম্পদ বিভাগে গিয়ে ভেড়ার জন্যে ফ্রি চিকিৎসা নেন। চিকিৎসা বাবদ কিছু টাকা খরচ হয়। ভেড়া পালন ও সমস্যার কথা বলতে নাদিরা বেগম বলেন, “চোরের উৎপাত আছে। এ পর্যন্ত আমার তিনটি ভেড়া চুড়ি হয়েছে। আবার তাদের আবাসনেরও সমস্যা। বৃষ্টি বাদল হলে একই খুপড়িতে নিজে এবং ভেড়া গাদাগাদি করে থাকি।”
বস্তির বেশীর ভাগ মানুষ তাদের পেশা হিসেবে ঝুট কুড়ানো, রিকসা চালানো, ভিক্ষা, বাসাবাড়ির কাজ, ছোট ব্যবসা, রিকশা চালক, সিএনজি/অটো ড্রাইভার, বাস/ট্রাক ড্রাইভার/কন্ট্রাক্টর, বিভিন্ন শ্রমিক, দিনমজুর, ভাঙারির ব্যবসা ইত্যাদি পেশা গ্রহণ করলেও নাদিরার ইচ্ছা ও স্বপ্ন একটু ব্যতীক্রমই বটে। তিনি শহরের ইট কাঠ পাথর আর উঁচু দালানের কোনায় সবুজ ঘাসের মতোই সংগ্রামী স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। কিন্তু দুঃখ হয় নাদিরার- দিনে দিনে শহরের সবুজ ঘাসের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে বিল্ডিং আর কংক্রিট দিয়ে ভরে যাচ্ছে। সবুজ নিশ্বাস নেবার জায়গাটুকুও কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে গাছ-গাছালি। কমে গেছে পাখির কলকাকলি। নাদিরার মতে, “একটি শহরে মানুষ যেমন বসবাস করে, তেমনি আর সকল প্রাণীদেরও বসবাসের স্থান থাকা উচিত। তাহলেই পরিবেশ ভালো থাকবে। সবাই মিলেইতো আমাদের পরিবেশ। কাউকে ছাড়া মানুষ শুধু একা বাঁচতে পারেনা। আর তাইতো এতো রোগবালাই বেড়ে গেছে মানুষের।” নাদিরার স্বপ্নের মতো বাংলাদেশের শহরগুলোর পরিবেশ গড়ে উঠুক। প্রান্তিক মানুষগুলো তার সবুজ স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাক।