বীজঘরে আমরা সবাই মিলে বীজ সংরক্ষণ করব
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
বীজ গ্রামীণ নারীর সম্পদ। গ্রামীণ নারীরা নিজ উদ্যোগে এবং নিজেদের প্রয়োজনে বৈচিত্র্যময় ফসলের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করেন। কিন্তু বীজ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান ও উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় নারীদের বীজ সংরক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে ব্যাহত হচ্ছে। নেত্রকোনা সদর উপজেলা মদনপুর ইউনিয়নের মনাং গ্রামে কুসুম কুলি কৃষাণী সংগঠন’র সদস্যরা সাংগঠনিকভাবে বীজঘর স্থাপন করে স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় সবজি, মসলা ও অন্যান্য ফসলের বীজ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নিজ গ্রামে একটি বীজঘর স্থাপন করেন।
সকল সদস্য তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন ফসলের বীজ তাদের বীজঘরে সংরক্ষণ করে পরস্পরের সাথে বিনিময় করছেন এই নারীরা। বীজঘর স্থাপনের ফলে বীজের জন্য সদস্যদের বাজারের উপর নির্ভরশীলতা অনেকটা কমে আসছে। গ্রামীণ নারীরা নিজের জ্ঞান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ফসলের বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, সবজি চাষ ও পরিচর্যা করে থাকে। কুসুমকলি কৃষাণী সংগঠনের ৬ জন সদস্য মূলেদা আক্তার, মমতা আক্তার, জাহানারা, মনোয়ারা, হুলদা আক্তার, আনোয়ারা আক্তারসহ প্রায় সকল সদস্যই চলতি মৌসুমে লাউ, সীম, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, বেগুন, ডাটা, মূলাসহ বিভিন্ন জাতের সবজি বীজ সংরক্ষণ করেছেন এবং বসতভিটায় চাষ করেছেন।
এই কৃষাণীরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে শুধুমাত্র জৈবসার ব্যবহার করে সবজি উৎপাদন করছেন। তাঁরা নিজেরাই সবজির বাঁশের মাঁচা তৈরি করে দিয়েছেন এবং নিজেরাই পরিচর্যা করছেন। এই বিষয়ে সংগঠনের সদস্য মমতা আক্তার বলেন, “আমি এই মৌসুমে ৫ ধরনের সবজি চাষ করেছি। সবজির জমিতে কোন ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দেই নাই। জৈব সার তৈরি করে সবজি ক্ষেতে দিয়েছি। বীজঘরে আমরা সবাই মিলে বীজ সংরক্ষণ করব। ফসল উঠার পর কয়েক গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের নিয়ে বীজ মেলার আয়োজন করব। সব ধরণের সবজির বীজ গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মাঝে বিনিময় করব। সবজি চাষে প্রত্যক নারীদের উৎসাহিত করবো।”
সংগঠনের অপর সদস্য মূলেদা আক্তার বলেন, “আমি এই মৌসুমে ৫ জাতের বেগুন নিয়ে গবেষণা করছি, পাশাপাশি লাউ, সীম, করলা ইত্যাদি সবজি লাগিয়েছি। আমি এবার চাষকৃত সকল ফসলের বীজ নিজের হাতে রাখবো। আমি প্রতি মৌসুমেই প্রয়োজনীয় বীজ সংরক্ষণ করি এবং অন্যদের সাথে বিনিময় করি। আমার স্বপ্ন গ্রামের প্রত্যেক নারীর কাছে যেন হাতে রাখা বীজ থাকে। আমাদের সংগঠনের সবাই হাতে বীজ রাখব এবং গ্রামের অন্য নারীদেরকেও উৎসাহিত করব বীজ রাখার জন্য। আমরা সবাই মিলে ঘরের কোণে ২টি বারোমাসি মরিচের চারা, বেগুনের চারা, কালো কচু লাগাবে এবং সবজির বৈচিত্র্যতা বাড়াবো।
কৃষাণী রিনা আক্তার বলেন, “আগে আমরা সবজির বীজের হালি রাখতাম। নিজের কাছে না থাকলে বাড়ি থেকে চাচী, মা, ফুফুর কাছ থেকে চেয়ে নিতাম। বাজারের দিকে চাইয়া থাকতে হইত না। এহন আমরা বাজার ছাড়া চোহে দেহি না। আজকের পর থেকে আমি নিজেই সবজির হালি রাখব।”
কৃষাণী বিলকিছ আক্তার বলেন, “আমরা গরিব মানুষ, আমাদের বাড়িভিটা ছাড়া কোন জায়গায় নাই। তাই আমারা সবজি বীজ লাগাতে পারি না।” কৃষক কালাম মিয়া বলেন, “অল্প জায়গাতে অনেক কিছু করা যায়। ঘরে কোনায় যদি বারোমাসী মরিচ, ডিম বেগুন, পেঁপে, চুকাই গাছ লাগানো যায় তাহলে সারাবছর এগুলো কিনতে হয় না।” কৃষক কালাম মিয়া ৬ জন কৃষাণীকে মরিচের চারা বিতরণ করেন।
কুসুম কলি কৃষাণী সংগঠনের ন্যায় প্রতিটি গ্রাম পর্যায়ে ছোট ছোট জনসংগঠন গড়ে তোলে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে সকল কৃষক-কৃষাণী পরস্পরের সাথে বীজ বিনিময় করলে বীজের জন্য কৃষকদের বাজারের উপর যেমন নির্ভরশীলতা কমবে, তেমনি কৃষকদের মধ্যে পরস্পারিক সম্পর্কে উন্নয়ন হবে এবং আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাবে।