লোকায়ত চর্চায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ

সত্যরঞ্জন সাহা, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর পদ্মা তীরবর্তী নিচু এলাকা। বর্ষা মৌসুমে মাঠে-ঘাটে পানি প্রবাহিত হয়ে পলি পড়ে। কৃষক নানান ধরনের ফসল আবাদ করেন। কৃষক পর্যায়ে প্রাকৃতিকভাবে হাজার বছর ধরে খাদ্য ও বীজ সংরক্ষণ চর্চা করে আসছেন। কিন্তু জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে আবাদে ব্যাহত হয়। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যাযমূল্য পাওয়ার জন্য প্রচলিত নিয়মে তার উৎপাদিত কৃষি ফসল সংরক্ষণ করেন। কৃষক পর্যায়ে অধিক পচনশীল পণ্য তথা শাকসবজি সরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। তবে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর, ঘিওর, শিবালয়ে ব্যাপকভাবে চাষকৃত পেঁয়াজ চাষে কৃষকরা ঘরের চাঙ্গে (Ceiling) পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেন। তাছাড়াও রোধে শুকিয়ে ধান, গম, ডাল, তেল, মসলা জাতীয় ফসল সংরক্ষণ করেন তারা।


এই বাহিরচরের কৃষাণি পিপাশা সরকার বলেন, ‘আমরা মাঠে ঘাটে কৃষি কাজ করি। আবাদের যে ফসল হয় তা থেকেই আমাদের সংসার চলে। আমাদের এলাকায় কৃষকগণ ব্যাপক পেঁয়াজ আবাদ করেন। আমরা এ বছর ১৫০ শতক জমিতে পিয়াজ আবাদ করি। দেশী পিয়াজ উৎপাদন হয় ২২০ মণ। তবে কৃষিতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। আবার মৌসুমে উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রয়ের সময় আমরা দাম কম পাই। ফলে প্রয়োজন হয় সংরক্ষণের। তবে সমস্যা হলো ছোট কৃষক বা অনেকেই ফসল সংরক্ষণ করতে পারে না। কারণ সংরক্ষণের জন্য ঘরের অভাব। আমাদের এবছর চাঙ্গে প্রায় ২০০ মণ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেছি। পেঁয়াজ সংরক্ষণ শিখেছি আমার শ^াশুরি নিকট থেকে। গ্রামে যুগ যুগ ধরে টিনের ঘরে চাঙ্গের মাচায় পেঁয়াজ রাখেন। তাতে দেখা যায় রোদের তাপ পায়, আবার ঘরের বেড়া ও টিনের চালের ফাকা দিয়ে বাতাস প্রবেশ করে। ফলে আলো বাতাস প্রবেশ করায় পেঁয়াজ কম পচে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাঙ্গে গিয়ে পেঁয়াজের অবস্থা কি হাত দিয়ে দেখি। পেঁয়াজ পচা শুরু করলে বিক্রয় করে দেই। কারণ পেঁয়াজ খুব দ্রæত পচে যায়। তবে ভাল একগলা পেঁয়াজ রাখলে কম পচে এবং বছর ব্যাপি রাখা যায়। কৃষক পর্যায়ে চাঙ্গে পেঁয়াজ রাখলে আনুমানিক শতকরা ৫ থেকে ৮ ভাগ পেঁয়াজ পচে। তবে পেঁয়াজ ভেদে পচন কম বেশি হয়। গ্রাম পর্যায়ে যারা পেঁয়াজ রাখে সবাই এভাবেই ঘরের চাঙ্গে রাখেন। একটু ভালো দাম পেলে বিক্রয় করে দেয়। আবার প্রয়োজনের সময় বাজারে সহজে পেঁয়াজ বিক্রয় করেন।’


শিকদার পাড়ার কৃষক মিজান খন্দকার বলেন, ‘আমাদের এলাকায় মাঠ ঘাট নিচু হওয়ায় পদ্মার পানি প্রবাহিত হয়। পলি পড়ে আবাদ ভালো হয়। এলাকার অধিকাংশ কৃষক পিয়াজ চাষ করেন। কার্তি ও অগ্রহায়ণে ছোট পিয়াজ বপন করি উঠে পৌষ মাসে। হরিরামপুর এই পেঁয়াজকে সাগা পিয়াজ বলে। এই পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না, বিক্রয় করে দিতে হয়। আবার পেঁয়াজের বীজ থেকে চারা করে পৌষ মাসে মাঠে বপন করা যায়। এই পেঁয়াজ উঠে চৈত্র মাসে। হরিরামপুরে এই পেঁয়াজকে আলি পেঁয়াজ বলা হয়। এই পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে থাকি। আবার বীজ হিসাবে সংরক্ষণ করে আবাদ করি। আমাদের এলাকায় গ্রামের কৃষক বহুকাল ধরেই পেঁয়াজ চাঙ্গে রাখেন। চাঙ্গে আলো, বাতাস ভালো পায় ফলে কম পচে। তবে এবছর আবাহাওয়া খারাপ, বৃষ্টি, ভাপসা গরম ভাব পিয়াজ বেশি পচে। এ বছর আমার এক মণে ৪ থেকে ৫ কেজি পেঁয়াজ পচে। তবে পেঁয়াজ চাঙ্গে থাকলে মণে ৬ থেকে ৮ কেজি ওজন কমে। গ্রামের শতভাগ কৃষক চাঙ্গে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে, কৃষক নায্যমূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।’

কৃষক-কৃষাণিগণ খাদ্য উৎপাদন আর বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রেখে মাঠে চাষ করেন হরেক রকমের ফসল। গ্রামের নারীরা এ সকল বীজ সংরক্ষণ করে আসছে। বীজ সংরক্ষণে এই চর্চা খাদ্য নিরাপত্তায় সহায়ক হয়। কৃষক পর্যায়ে আবাদে সহায়ক হয়।

happy wheels 2

Comments