ঐতিহ্যেকে পরিচয় করিয়ে দেয়া খাবার

মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক

বাঙালী সংস্কৃতি ও কৃষ্টির অপরিহার্য অংশ হলো মেলা। আমাদের জীবনের সঙ্গে মেলার যোগ দীর্ঘকালের। উৎসব, বিনোদন, বিকিকিনি আর সামাজিক মেলবন্ধনের উত্তম ক্ষেত্র হচ্ছে মেলা। বিশেষ করে নববর্ষ উপলক্ষ্যে আয়োজিত বৈশাখী মেলা বাঙালীর চেতনাকে উজ্জীবিত করে তোলে। মেলায় বিনোদনের পাশাপাশি রসনা তৃপ্তির জন্যে থাকে বিভিন্ন রকম মিষ্টি, জিলাপি, সাজ-কদমা, খাজা, বাতাসা, হাওয়াই মিঠাইসহ হরেক রকমের টক-ঝাল-মিষ্টি খাবার। আর খাবারের দোকানগুলোতে থাকে সব বয়সের মানুষের উপচে পড়া ভিড়। শিশু কিশোরসহ সব বয়সীদের প্রধান আকর্ষণ থাকে এসব মজাদার খাবারের প্রতি। আবহমান বাংলার দীর্ঘদিনের লালিত ঐতিহ্যবাহী এসব খাবার নতুন প্রজন্ম কিংবা শহুরে মানুষের কাছে আরো পরিচিত করে দেয় মেলাসহ বিভিন্ন উপলক্ষ্য। গ্রামীণ সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগে নগর সংস্কৃতিতেও।

manikgonj (2)নববর্ষ উপলক্ষে শুধু গ্রামেগঞ্জেই নয়, শহরেও আয়োজন করা হয় মেলার। দোকানিরা মুড়ি, মুড়কি, সাজ-কদমা, মিঠাইসহ নানা বর্ণের হরেক স্বাদের মুখরোচক খাদ্য দ্রব্য নিয়ে বসেন। আর নাগরিক জীবনেও এসব খাবারের কদর যেন আরো বেশি গাঢ়। এসব খাবারের প্রধান তালিকায় থাকে, নানা রকম বিন্নি খই, চিনি সাঁজ, বাতাসা, ছাতু, মিষ্টি ইত্যাদি। আর এসব খাবার যেন নতুন উদ্দোমে নতুন প্রজন্মের কাছে করে তুলছে আরও আকর্ষণীয়।
গ্রামীন মেলা কে কেন্দ্র করে বিন্নির সাথে, বড় বাতাসা, ঘোড়া, হাতি, মটুক, পাখি ও নৌকার সাজ ছাড়া যেন চলেই না। আর এ সাজ তৈরি করেই সংসার চালাচ্ছেন মানিকগঞ্জের প্রায় অর্ধশত পরিবার। বৈশাখী মেলা উপলক্ষ্যে সাজ কারিগড়দের সময় কাটে ভীষন ব্যস্ততায়।

হরেক স্বাদের মিষ্টি ছাড়া বৈশাখী মেলা কল্পনাও করতে পারে না মানিকগঞ্জের লোকজন। এছাড়াও সারাদেশেই রয়েছে মানিকগঞ্জের মিষ্টির কদর। রসগোল্লা, জিলাপী, দধি, মাসকলাই আমিরতী, রসমালাই, সন্দেশ, কালোজাম, চমচম তৈরী করতে দুধ, চিনি, গুড়, মাসকলাইসহ অন্যান্য উপকরণ ক্রয় এবং মিষ্টি তৈরী করার কাজে দম ফেলার ফুসরত নেই ঘোষপাড়ার নারী-পুরুষদের।

manikgonj (3)হাওয়ার মিঠাই! শিশুদের মন ভোলানো পছন্দের অন্যতম খাবার। মুখে দিলে নিমিষেই হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়। এক সময় গ্রামে গ্রামে হাঁক ডেকে বিক্রি করতো হাওয়াই মিঠাই ফেরিওয়ালারা। তবে বড়দের পছন্দের খাবারের তালিকায়ও জায়গা রয়েছে বাহারি রংয়ের আর হরেক আকৃতির হাওয়ার মিঠাইয়ের। কালের পরিক্রমায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে হাওয়াই মিঠাইয়ের ফেরিওয়ালাদের সংখ্যা। কারণ বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি এখন হাতের মুঠোয়। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন মানুষের দোরগোড়ায় হাজারো নামি-দামি খাবার। তবে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে শহর-গ্রামে সমান জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে হাওয়াই মিঠাইয়ের।

বিশেষ প্রক্রিয়ায় চিনিকে তাপ দিয়ে বিশেষ মেশিনে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়ায় মিঠাই তৈরি করা হয়। সাদা ও গোলাপি দু’ধরনের হাওয়ায় মিঠাই হয়ে থাকে। গ্রামে ভ্যানের উপর হাওয়ায় মিঠাই তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে হাওয়ায় মিঠাই তৈরি করতে দেখা যায়। কাঁচ দিয়ে ঘেরা বাক্সে ছোট ছোট গোলাকার এবং বড় আকারে হাওয়াই মিঠাই পলিথিনে মুড়িয়ে বাঁশের সাথে বেঁধে ফেরিওয়ালারা বিক্রি করেন।

মানিকগঞ্জের বালিরটেক এলাকার জব্বার মৃধা। প্রায় এক যুগ ধরে হাওয়াই মিঠাই তৈরি ও বিক্রির পেশার সাথে জড়িত। এ কাজ করেই তার ৬ সদস্যের জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তিনি জানান, হাওয়াই মিঠাই এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে বংশ পরম্পরায় ধরে রাখতে এ ব্যবসা চালিয়ে আসছি। সম্প্রতি ঘিওরের এক গ্রাম্য মেলায় হাওয়াই মিঠাই কেনার সময় জয়া, লিজা, রিতু, জেবিন, তামিমসহ কয়েকজন শিশু বলেন, “হাওয়াই মিঠাই; মজাই আলাদা। এটি খেতে আমাদের খুব ভাল লাগে।”
বৈশাখী মেলা ও এর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন শিল্পীদের সম্পর্কে মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি গোলাম ছানোয়ার ছানু বলেন, “এসব পেশার সাথে জড়িতরা অনেকটাই মানবেতর জীবন যাপন করছে। এসব শিল্পী ও কারিগরদের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে বাঙালীর আদি ঐতিহ্যবাহী এসব রসনা তৃপ্তিদায়ক খাবার।”

বৈশাখ মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব। নতুন বর্ষকে বরণের পাশাপাশি উৎসবকে পরিপূর্ণতা দেয় বৈশাখী মেলা। বৈশাখী মেলা শুধু গ্রামেই নয়, শহুরে মানুষদের বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এসব খাবার।

happy wheels 2

Comments