আশুজিয়া গ্রামে স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চার পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে ২৯ মার্চ ২০২০ থেকে দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন বন্ধ থাকায় নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন গ্রামের শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জনগোষ্ঠী করোনাকালীন হোম কোয়ারেন্টাইনের দীর্ঘ সময় ঘরে থেকে কৃষি ও পরিবেশ উন্নয়নসহ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে চলেছেন। এ সময়ে তারা বসতভিটায় ও কৃষি জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, নার্সারি স্থাপন, বৃক্ষ রোপণ ইত্যাদি উদ্যোগ সাফল্যের সাথে বাস্তবায়ন করেছেন।

নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের আশুজিয়া গ্রামের ‘আশুজিয়া কৃষক সংগঠন’র সভাপতি কৃষক আবুল কালাম মিয়াও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। তিনি করোনাকালীন সময়ে গ্রামের বাইরে না গিয়ে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি নিজে জৈব উপায়ে সবজি চাষের পাশাপাশি সংগঠনের ৩০ জন সদস্যকে জৈব উপায়ে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষের মাধ্যমে সবজির বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যময় নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ লক্ষ্যে তিনি সংগঠনের সদস্য ও গ্রামের অন্য কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে বৈচিত্র্যময় সবজি বীজ বিনিময় ও বিতরণ, কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনের জন্য কেঁচো দিয়ে সহযোগিতা করছেন। সংগঠনের সভায় তিনি সদস্যদেরকে বাজার থেকে সবজি ও সবজি বীজ না কিনে, তাঁর নিকট থেকে ও সংগঠনের বীজঘর থেকে বীজ নিয়ে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করার পরামর্শ দেন। গৃহস্থালীর উৎছিষ্ট অংশ, গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করে বাড়িতে বাড়িতে জৈব সার ও কমপোস্ট তৈরি করে সবজির ক্ষেতে নিয়মিত ব্যবহার করার পাশাপাশি উদ্বৃত্ত¡গুলো বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করা যায় বলে কালাম মিয়া সদস্যদেরকে উৎসাহিত করেন। গ্রামের পাঁচজন কৃষক জৈব সার তৈরি করে বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছেন।

আবুল কালমা মিয়া বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের লক্ষ্য হল পতিত জমি ও বসতভিটার জমির সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন, পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, মানসম্মত শস্য ফসলের বীজ সংরক্ষণ করে কৃষি উপকরণের জন্য বাজার বা কোম্পানির উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা। পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে কৃষকদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পারস্পারিক ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করা। সর্বোপরি প্রতিটি সদস্য পরিবারকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলা।’ এই কৃষকের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামের সকল কৃষক-কৃষাণী করোনাকালীন সময়ে নিজ নিজ বসতভিটা ও অনাবাদি পতিত জমি সবজি চাষের উপযোগী করে তুলেছেন। কৃষক আবুল কালাম মিয়া ৭০ শতাংশ জমিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেন। বিভিন্ন মৌসুমে তিনি জৈব উপায়ে-ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, করলা, পুঁইশাক, ঢেড়স, বেগুন, বরবটি, সীম, চালকুমড়া, শশা, পেঁপে, আলু, ডাটা, মূলা, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, মরিচ, ধনিয়া, হলুদ, গুয়ামুড়ি, আদাসহ নানান প্রকার সবজি ও মসলা ফসল চাষ করেন। পাশাপাশি তিনি উৎপাদিত ধান, সবজি ও মসলা ফসলের বীজ সংরক্ষণ করে বীজ মেলা ও বীজ বিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

আবুল কালাম মিয়ার চাষকৃত সবজির ৭০ শতাংশ জমিতে বাজারের কোন সার (রাসায়নিক) ও কীটনাশক ব্যবহার করেন না। করোনার মোকাবেলায় শীরের এন্টিবডি বৃদ্ধি ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে গ্রামের সকল কৃষক নিজ উদ্যোগে জৈব সার তৈরি করে নিরাপদ উপায়ে সবজি চাষ করছেন। প্রতিটি পরিবারে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করায় পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও তাঁরা সবজি বিক্রি করে সেই অর্থে সংসারে অন্যান্য খরচ যোগাতে পারছেন। করোনাকালীন সময়ে গ্রামে অনেক সবজির চাষ হওয়ায় বিভিন্ন এলাকার সবজি পাইকারগণ কৃষকদের বাড়ি থেকে সবজি কিনতে আসছেন। আশুজিয়া গ্রামের কৃষকরা জৈব উপায়ে বিষমুক্ত সবজি চাষ করায় বাজারে তাদের সবজির দাম ও চাহিদাও বেশি। বাজারে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সমস্ত সবজি বিক্রি হয়ে যায়, ফলে পাইকারদের নিকটও এ গ্রামের সবজির চাহিদা অনেক। গ্রামের যেসকল কৃষক পরিবার করোনাকালীন সময়ের আগেও বাজার থেকে সবজি কিনে খেতেন, তারা নিজেরাই এখন রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত সবজি চাষ করে পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও বাজারে বিক্রি করছেন।

সংগঠনের পাঁচজন সদস্য আলামিন, নয়ন, রুবেল, রিনা আক্তার, রুপা আক্তার নিজেদের চাষকৃত সবজির জাতগুলোর অনেক বীজ সংরক্ষণ করেছেন। বীজ সংরক্ষণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা জানান, নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর উদ্বৃত্ত¡ বীজ গ্রামের বীজঘরে রাখেন গ্রামের অন্যদের সাথে বীজ বিনিময়ের জন্য। এভাবে পারস্পারিক বীজ বিনিময়ের সংস্কৃতি চালুর মাধ্যমে গ্রামের সকল কৃষকদেরকে সবজি বীজের ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারবেন বলে তাঁরা অভিমত প্রকাশ করেন।
স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ, বীজ উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ, বীজ বিনিময় এবং পরিবেশসম্মত উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতি এবং তথ্য নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের কৃষকদের সাথে সহভাগিতার ফলে গ্রামের অধিকাংশ মানুষই এখন তাদের উৎপাদিত ফসলের বীজ সংরক্ষণ করছেন এবং পরস্পরের সাথে জৈব সার ও কেঁচো বিনিময় করছেন, যা করোনা মোকাবেলায় নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

happy wheels 2

Comments