নানান সমস্যার আবর্তে খাসিদের জীবন ও জীবিকা
সিলভানুস লামিন
এক
প্রকৃতির সঙ্গে খাসিদের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ওই এলাকা অনাবাদী ও পরিত্যক্ত পাহাড়গুলোতে গাছ রোপণ ও লালন-পালনের মাধ্যমে খাসিদের পান চাষ প্রক্রিয়া শুরু হয়। অথচ এসব পাহাড়-টিলা আবাদযোগ্য করে তোলার পর তথাকথিত সামাজিক বনায়ন, উন্নয়ন প্রকল্প কিংবা জোরদরবস্তির মাধ্যমে কৌশলে ওইসব সম্পদ থেকে খাসিদের প্রবেশাধিকার বিপন্ন করা হয়। পত্রিকান্তরে প্রায় দেখি, কোন কোন পুঞ্জির মানুষের পান লতা কেটে ফেলা হয়, কোন কোন পুঞ্জি এলাকায় পরিকল্পিত সহিংস ঘটনা ঘটিয়ে খাসিদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয় । আবার কোথাও কোথাও খাসিদের অস্থায়ী বাসিন্দা দেখিয়ে খাসিদের যত্নে গড়ে উঠা বন, গাছপালা সাবাড় করার পায়তারা করা হয়। কৌশল একটাই; এই জনগোষ্ঠীকে বিতারিত করা। সবার তথ্যের জন্যই বলছি, খাসিরা কখনও পাহাড় পোড়েনা, কখনও গাছ নিধন করে না। কারণ পাহাড়, বন বা বৃক্ষ তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। বন, পাহাড় ও গাছ না থাকলে বাংলাদেশের খাসিরা তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবেন না। তাই যে প্রাকৃতিক উপাদান একটি জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সে জাতি কোনভাবেই সেই বন, পাহাড় বা বৃক্ষ নিধন করতে পারে না। তাদের জীবনের প্রয়োজনেই এগুলোকে রক্ষা করতে হয়। তাই তো খাসি গ্রামের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, সারি সারি গাছ, ওই গাছের গায়ে আপনমনে লতা জাতীয় পান আকড়ে থাকার দৃশ্য, খাসিদের বাসস্থানের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং প্রকৃতির সাথে নিবিড় যোগাযোগ। বাংলাদেশে যে এলাকায় খাসিদের বসবাস রয়েছে সেই এলাকার প্রাকৃতিক বন এখনও সুরক্ষিত। সেই বন-বাদারে এখনও কোটি কোটি প্রাণবৈচিত্র্য তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে এখনও।
দুই
বন, বৃক্ষ, পাহাড় ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় অশেষ অবদান রাখার পরও নানান কারণেই খাসিদের জমি-জমার পরিমাণ দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের জবর দখল, সম্পদ নষ্ট, গ্রাম উচ্ছেদ করা এবং সর্বোপরি কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে খাসিদের জমি দখল হচ্ছে এবং এ দখলের প্রক্রিয়া এখনও চলমান। এছাড়া কৌশলে জুমের গাছ ও পান লতা কেটে নষ্ট করার মধ্য দিয়েও খাসিদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়ণের চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। কারণ পান ও গাছ না থাকলে খাসিরা চাষাবাদ করতে পারে না। পান চাষের জন্য গাছ অপরিহার্য। গাছ না থাকলে পান চাষ সম্ভব হবে না। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে খাসিদের নানানভাবে বিতারিত ও উচ্ছেদ করার অপতৎপরতাগুলো পত্রিকান্তরে দেখে আসছি। ঝিমাই পুঞ্জি, এবং নাহার পুঞ্জি চা বাগান কর্তৃক নির্যাতনের খবরাখবর পত্রিকায় দেখেছি। নিকট অতীতে মৌভীবাজারের চলিতা ছাড়া বনবিভাগ কর্তৃক, বালাইমরা পুঞ্জি স্থানীয় প্রভাবশালীদের কর্তৃক, বড়লা পুঞ্জি পাথর ব্যবসীয় কর্তৃক প্রায় বেদখল হওয়া ঘটনা দেখেছি। এছাড়া খাসিদের প্রায় অনেক গ্রামই কোন না কোন সময়ে দখল ও কেড়ে নেওয়ার আওতায় পড়েছে। খাসিদের ঐতিহ্যবাহী ‘জনগোষ্ঠী ভূমি মালিকানা’ (Community land ownership ) কে স্বীকৃতি না দেওয়া, ব্যক্তিগত জমি-জমার কাগজপত্র হালনাগাদ না করা, কিংবা হালনাগাদ কাগজপত্র করার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত না হওয়া, আইনের মারপ্যাঁচ না বুঝা এবং সর্বোপরি অজ্ঞতার কারণে দলিলপত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করতে না পারার কারণে খাসিদের এসব জমি দখল ও জোর করে দখল করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে অনেকবার।
তিন
খাসিদের কৃষি হচ্ছে প্রকৃতিনির্ভর। এই কৃষি চর্চার ক্ষেত্রে খাসিরা তাদের ঐতিহ্যবাহী বা লোকায়ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেন। মূলত অর্থকরী ফসল চাষই খাসিদের কৃষির প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে অন্য অর্থকরী ফসলের মধ্যে পান অন্যতম। খাসিদের উৎপাদিত পান দেশে ছাড়া বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রায় ৯৯ ভাগ খাসি পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই পান চাষ প্রক্রিয়ায় জমি, শ্রম, পুঁজি এবং সংগঠনের দরকার পড়ে। পান চাষ প্রক্রিয়ায় খাসিরা কখনও রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে না; বরং জৈব সার এবং প্রকৃতিতে আপন নিয়মে পচে যাওয়া ঘাস, পাতা, কাঠ পান গাছটিরর গুড়িতে স্তুপাকৃতভাবে জমা রাখে যাতে সেগুলো সারের কাজ করে। খাসিরা তাদের লোকায়ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে পান চাষ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে খাসিরা তাদের জীবন ও নিত্যদিনের জীবিকার মাধ্যমেই পরিবেশ সুরক্ষার কাজ করে আসছেন। পূর্বেই বলা হয়েছে, খাসিরা তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবিকার মাধ্যমেই প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সুরক্ষার কাজ করে আসছেন সুদীর্ঘ বছর ধরে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এই জনগোষ্ঠী নিরবে অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু তাদের এই অবদানের কোন স্বীকৃতি এখন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেওয়া হয়নি। তাই তো আশি দশকের দিকে যেখানে বাংলাদেশে তিনটি জেলায় প্রায় ১০৮টি পুঞ্জি ছিলো সেখানে বর্তমানে এই সংখ্যা কমে একশ’র নীচে নেমেছে। বিলুপ্ত গ্রামগুলো হলো-মানাখেলা পুঞ্জি, বোবা পুঞ্জি, গুটুম, ইনাই পুঞ্জিসহ আরও বেশ কটি পুঞ্জি। এছাড়া জাফলং এর বড়লা পুঞ্জি এক অর্থে প্রায় বিলুপ্তই হয়েগেছে। এ গ্রামটিতে একসময় শুধুমাত্র খাসিরা বসবাস করলেও বর্তমানে খাসিদের তুলনায় বাঙালিদের সংখ্যায় বেশি। কারণ ওই গ্রামটিসহ খাসিদের অন্যান্য গ্রামগুলোর বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে প্রভাবশালীর হাত রয়েছে। প্রভাবশালীরা কৌশলে বা জবরদস্তি করে তাদের ভূমি দখল অথবা স্বল্পদামে তাদের জমিগুলো বিক্রি করতে বাধ্য করে সেখানে পাথর উত্তোলন করছে। প্রশাসন তথা সরকার কাছ থেকে নিজ জমি মালিকানা রক্ষার জন্য কোনও সহযোগিতা খাসিরা পায়নি।
চার
বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে আইএলও কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে। ILO convention এর C-169 Indigenous and Tribal Peoples Convention 1989 -এর ১৪নং অনুচ্ছেদের (১)-এ বলা হয়েছে, ‘এসব জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে আয়ত্তকৃত জমির মালিকানার অধিকার ও ঐতিহ্যগতভাবে দখলীস্বত্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। অধিকন্তু, ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহারকৃত জমি যা, তাদের জীবনযাপন এবং ঐতিহ্যবাহী কার্যক্রমে ব্যবহার করতো সেগুলো রক্ষা করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’ অনুচ্ছেদ ১৪ (২) এ বলা হয়েছে, সরকার এসব জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে আয়ত্তকৃত ভূমি চিহ্নিতকরণ এবং তাদের মালিকনার অধিকার ও দখলীস্বত্বে কার্যকরী নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করবে।’ তবে সরকারের অনুসাক্ষরিত এই কনভেনশনে এসব বিষয় থাকলেও খাসিদের জমি-মাটি, বসতভিটা, সম্পদ এবং গ্রাম দখল করার প্রক্রিয়া এখনও কমেনি বরং দিনে দিনে আরও বেড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে-বড়লা পুঞ্জির মর্জিনা লামিন প্রায় ১১ একর জমি বাধ্য হয়ে বিক্রি করে অন্যত্র চলেগেছেন। এর আগে তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে ওই জমি রক্ষার জন্য সরকারের সঙ্গে মামলা লড়েছেন। কিন্তু তিনি নানান জটিলতায় পেরে না ওঠে অবশেষে স্বল্প দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। মর্জিনা লামিন ছাড়াও আরও অনেক খাসি পরিবার আজ অন্যত্র ঠিকানা পেয়েছে মূলত এদেশে তাদের ভোগ-দখলকৃত জমিগুলো বেদখলের হওয়ার কারণে।
পাঁচ
সিলেট জেলার খাসিসহ অন্যান্য আদিবাসীদেরও ভূমির ক্ষেত্রে একই নির্মম অভিজ্ঞতা রয়েছে। পদে পদে দলিত ও মথিত হয়ে আদিবাসীদের জমি-জমা কমতে শুরু করছে। কোনও কোনও আদিবাসীদের বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। খাসিসহ অন্যান্য আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন তারা এদেশের আদিবাসিন্দা। সিলেটের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখলে দেখা যাবে খাসিরা এ দেশের আদি বাসিন্দা। খাসিসহ আদিবাসীরা যে এলাকায় বাস করেন তারাই ওই এলাকার প্রথম বসতি স্থাপনকারী। স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা যায় যে, যারা কোনও ভৌগলিক এলাকার প্রথম বাসিন্দা তারাই উক্ত এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ তথা মাটি, পানি, বায়ু বনজঙ্গলের ওপর নিরঙ্কুশ অভিগম্যতা ও অধিকার লাভ করবে। কিন্তু আমাদের দেশে আজ এই আদি বাসিন্দাদেরই কোনও জমি নেই, নেই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তাদের প্রবেশাধিকার। জমি-জমা কমে যাওয়া, বেদখল হওয়ার কারণে এরা যাযাবর জীবন যাপন করেছে। ফলে তাদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে নানা প্রতিন্ধকতা দেখা দিয়েছে। আজ অনেক আদিবাসীই তাদের ভাষাসহ সাংস্কৃতিক বিভিন্ন উপাদান হারাচ্ছেন। ফলে যে, স্বকীয়তার জন্য ‘আদিবাসী’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা’ বিশেষ মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন সেই স্বকীয়তাও বিলুপ্ত হচ্ছে। বিলুপ্ত হচ্ছে তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য যা, মূলধারার সংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যমন্ডিত করেছে অনেক সময়। তাই আদিবাসীদের এই বিপন্ন অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য তাদের স্বীকৃতি দিয়ে ভূমি-মাটি-পানি-বায়ু তথা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যথোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি বলে মনে করি। আদিবাসীদের ভূমি বাঁচলে আদিবাসীরা বাঁচবে, আদিবাসীরা বাঁচলে তাদের সংস্কৃতিও বাঁচবে এবং বাঁচবে এদেশের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা ও সংস্কৃতিও।