সাম্প্রতিক পোস্ট

পুলিশ হওয়ার স্বপ্নে এগিয়ে যাচ্ছে অন্তরা রাজবংশী

পুলিশ হওয়ার স্বপ্নে এগিয়ে যাচ্ছে অন্তরা রাজবংশী

মানিকগঞ্জ থেকে ঋতু রবি দাস

বারসিকে আমার কর্ম জীবন শুরু হয় ২০২১ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে। আর অন্তরার সাথে আমার পরিচয় হয় মে মাসে কাজের সুবাদে। অন্তরা রাজবংশী (১৮)। মানিকগঞ্জ শহরস্থ জয়নগর রাজবংশী পাড়ায় তার বাড়ি। তার মা বাবার একমাত্র সন্তান সে। তার বাবার নাম শ্যামল রাজবংশী (৪৩) মাতার নাম ভারতী রাজবংশী (৩৫)। সে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে, মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সে ৩.৭৮ পেয়ে জয়নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে ২০২২ সালে। তবে এতদূর আসতে তার জীবনে অনেক চড়াই উৎড়াই পাড় করতে হয়েছে। গ্রামে থাকায় তার মা বাবা বাল্য বিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। মেয়ে নাছোরবান্দা, সে মেট্রিক পাশ না করে বিয়ে করবে না। তার বাবা রাজমিস্ত্রি। অন্তরার ঠাকুমা তাদের সাথেই থাকেন। তাদের গরু আছে। যখন থেকে তাদের সাথে আমি কাজ শুরু করি, তখন থেকেই তার মধ্যে আমি ব্যতিক্রম কিছু লক্ষ্য করি। সব কিশোরীদের চেয়ে সে সব কিছুতেই বেশি সক্রিয়। তাই যখন কিশোরী সংগঠন করি তাকেই সভাপতি করে সংগঠনটা করি।

গ্রামে, শহরের চেয়ে বাল্য বিয়ের প্রচলন বেশি। মা বাবারা মনে করেন মেয়ে বিয়ে দিলেই বাঁচি। অন্তরার একটা মজার কাহিনি আছে, সেটা হলো একবার এক পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে আসছিলো। সেই পাত্রপক্ষের সামনে প্যান্ট শার্ট পরে সে হাজির হয়। তাতে যা হওয়ার তাই হয়। গ্রামের পরিবেশে পাত্রপক্ষের সামনে শাড়ি, থ্রি পিস না পরে, প্যান্ট শার্ট পরে যাওয়ায় তারা রেগে চলে যায়। দিন যায়, তার সাথে ঘনিষ্ঠতা আমার বাড়তে থাকে। তার মা বাবার সাথেও আমার সম্পর্ক মেয়ের মত হয়ে যায়। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আমি তাদের মধ্যে বিশ^াস অর্জন করতে সক্ষম হই। অন্তরা তখন নবম শ্রেণিতে পড়ে, একটা ছেলে দেখতে আসলো। ছেলেটা বেসরকারি স্কুলে কেরানির চাকরি করে। অন্তরাকে দেখেই তার পছন্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্তরা আমাকে কল দিয়ে জানায়, ‘দিদি আমি বিয়ে করতে পারবো না। আমি মেট্রিকটা পাশ করতে চাই।’

আমি একদিন গেলাম তাদের বাড়িতে, গিয়ে তার মায়ে‘র সাথে কথা বলি। তাকে বুঝাই অন্তত সে মেট্রিক পাশ করুক, তারপর না হয় তাকে বিয়ে দিতে পারেন! তার ইচ্ছা পুলিশ হওয়ার, অন্তত তাকে একটা সুযোগ দিন। তখন তার বাবা মা রাজি হয়। এরপর অনেক জায়গা থেকেই তাকে দেখতে আসে এবং মেয়ের জেদের কাছে মা-বাবা হেরে যান। করোনাকালীন সময়ে বিদ্যালয় বন্ধ থাকাতে সবার পড়ার ক্ষতি হয়। অনলাইনে ক্লাস করার জন্য এন্ড্রোয়েড ফোন কিনতে হবে। করোনার সময় কাজের বেহাল দশা। অন্তরা দর্জির কাজ করতো। অনলাইন ক্লাস করতেই হবে, তার জন্য নিজের জমানো টাকা এবং তার বাবার কিছু টাকা দিয়ে সে একটা মোবাইল কিনে। মোবাইলটা কিনতেও আমাকে সে নিয়ে যায়। করোনাকালীন সময়ে সে পাড়ার শিশুদের এ্যাসাইনমেন্ট করে দিতে সাহায্য করে।

একটা মানুষ একাধারে কত গুনে গুনান্বিত হতে পারে, তাকে না দেখলে আমি বিশ^াস করতে পারতাম না। সাইকেল চালানো থেকে শুরু করে, নৌকা চালানো, মাছ ধরা, গাছে উঠা, রান্না করা, মাঠে গিয়ে গরুর জন্য ঘাস কাটা সব পারে। ২০২১ এর বন্যার সময় সে আমাকে নৌকায় নিয়ে ঘুরায়। তার উঠানে অনেক ফুল গাছ লাগিয়ে রাখছে। সে সেলাই কাজ করে নিজের খরচ নিজেই চালায়। ইন্টারনেটে যা দেখে সেটাই সে করতে পারে। ইন্টারইেঁ থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় দেখে সে সেগুলো আয়ত্ব করার চেষ্টা করে। আর্ট এর জন্য তার প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেই, তবুও সে আর্ট করতে পারদর্শী। সে মুরগিও পালন করে। জয়নগর গ্রামে সব মেয়েদের জন্য সে একটা উদাহরণ। বিয়ে করবে তবে অবশ্যই নিজের ইচ্ছা পূরণ করে। তার ইচ্ছা পুলিশ হওয়ার, সে তার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে।

happy wheels 2

Comments