নিছুলা হাজংয়ের একাকীত্ব এবং লাউ বাগান

কমলাকান্দা, নেত্রকোনা  থেকে গুঞ্জন রেমা

একা থাকা যে কত কষ্টের তা শুধুমাত্র যে থাকেন তিনিই একমাত্র জানেন। কলমাকান্দা উপজেলার খারনৈ ইউনিয়নের বনবেড়া গ্রামে বাস করেন নিছুলা হাজং (৫৯)। পরিবারে এখন তিনি একাই থাকেন। এক মেয়ে ছিল তারও বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী মারা গেছে প্রায় দেড় বছর হলো। সব মিলিয়ে এখন তিনি একা। মেয়ে জামাই প্রায়ই এসে দেখে যান। কখনো বা নাতি নাতনীদের নিয়ে এসে একাকিত্ব দূর করেন।

পাশবর্তী একটি বাঙালি পরিবারের দেখাদেখিতে গত বছর মেয়ে জামাইয়ের সহযোগিতায় নিছুলা হাজং লাউ এর বাগান করতে শুরু করেন। মোট ৭ হাজার টাকা খরচ করে সেই লাউ বাগান থেকে আয় করেছিলেন ৩০ হাজার টাকা। গত বছরের প্রেরণায় এবার আরো বেশি পরিমাণে লাউ বাগান করেছেন। বাগান করার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যতগুলো কাজ আছে সব তিনি নিজেই করেন। কখনো বা শ্রমিক নিয়ে কাজ করান। লাউ বাগানে সার হিসেবে তিনি গরুর গোবর সংগ্রহ করেন। যেখানে গরু চরানো হয় সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করেন তিনি। সংগৃহীত গোবরগুলো একসাথে জমা করে জৈব সার তৈরি করে লাউ বাগানে দেন।

nichola
লাউ বাগান করার পূর্বে তিনি পাহাড় থেকে লাকড়ি (জ্বালানি) সংগ্রহ করতেন। এখন তার পক্ষে পাহাড় থেকে লাকড়ি এনে বাজারে বিক্রি করাটা খুবই কষ্টের। তাই তিনি একটু কম কষ্টের কাজ করার জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান। লাউ বাগান করাটা যদিও কিছুটা কষ্ট স্বীকার করতে হয় তাকে তথাপি পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করা থেকে তুলনামূলকভাবে কম কষ্টের। যাই হোক, কোন কাজই যেমন খুব সহজ নয় তেমনি অসাধ্য নয়। লাউ চাষ করতে গিয়ে তিনিও কিছুটা সমস্যার সন্মুখীন হয়েছে। তবে ইচ্ছাশক্তি ও উদ্যম কারণে সেই সমস্যাকে তিনি দূর করতে পেরেছেন।

পরিবারে একা থাকা সবসময়ই কষ্টের তবে নিছুলা বেগম নিজেকে ব্যস্ত রাখার মধ্য দিয়ে সেই একাকীত্ব দূর করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে লাই বাগানই হচ্ছে তার ভরসা। লাউ বাগানে কাজ করেই প্রতিদিন সময় কাটান তিনি। এছাড়া লাউ বাগানে ফসল ধরা দিলে এবং বিক্রির উপযোগী হলে তাঁর বাড়িতে ক্রেতাদের আনাগোনা হয়। আবার বিক্রিযোগ্য লাউ বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে গিয়েও তিনি বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গ লাভ করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “লাউ এখন বাজারে বিক্রির সময় চলে এসেছে। আমার বাড়িতে লাউ কেনার জন্য পাইকারদের আনাগোনা বাড়ছে। পাইকাররা বাগানে এসে লাউ ক্রয় করছে। এছাড়া নিজেও পাশবর্তী বনবেড়া গ্রামের পাশেই একটি বাজার আছে সেখানে আমি লাউ বিক্রি করে সময় কাটাই।”

শুধুমাত্র একাকীত্ব দূর করার জন্যই তিনি লাউ বাগান করেননি; বরং নিজের সবজির চাহিদা পূরণ, জীবিকা নির্বাহ এবং সর্বোপরি বিষহীন খাদ্য যোগানের জন্যও তিনি এই বাগান করেছেন বলে জানান। লাউ বাগানে কোন ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক না দেওয়ায় বাজারে এবং ক্রেতাদের কাছে তাঁর লাউয়ের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া লাউ বিক্রি করে তিনি যে টাকা আয় করেন সেটা দিয়ে সংসারের অন্যান্য প্রয়োজন কিনতে পারছেন।

nichula-1
বাংলাদেশের সাধারণ চিত্র বলে এই বয়সে কোন নারীই সাধারণত কোন ভারি কাজের সাথে কম যুক্ত হন না। তবে নিছুলা হাজং ব্যতিক্রম। তিনি তাঁর একাকিত্বকে দূর করার জন্য লাউ বাগান করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মনে করেন এখন তিনি আগের চেয়ে ভালোই আছেন। আগে বাড়িতে থাকতে পারতেন না এখন সারাদিন বাড়িতে থাকতে পারছেন। বাড়িতে থেকে এখন তিনি গরু ছাগলও পালন করছেন। যা তার সংসারের আয়ের আরো একটি উৎস হিসেবে যোগ হয়েছে।

এভাবে দেখা যায়, যদি ইচ্ছাশক্তি থাকে তাহলে মানুষ নিজেই তার সমস্যার সমাধান করতে পারেন। অন্যরা হয়তোবা পরামর্শ দিতে পারেন তবে কাজটা নিজেকেই করতে হয়। নিজের একাকীত্বকে দূর করার জন্য লাউ বাগান করে শুধু সফলতাই পাননি নিছুলা হাজং বরং সবাইকে দেখিয়েছেন কীভাবে নিজের সমস্যা দূর করা যায়।

happy wheels 2