১৬২ পদ চা : কবি মামার চায়ের দোকান
নেত্রকোনা থেকে আওলাদ হোসেন রনি
উনিই হলেন কবি মামা
চায়ের দোকানদার
চা বানাতে ভারী পটু
তুলনা নেই যার।
একটি দীর্ঘ কবিতার প্রথম চার লাইন। কবিতাটি লিখেছেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্র এবং সাহিত্যকর্মী এ.টি.এম শফিউল্লাহ। কবিতাটি যাকে নিয়ে লেখা হয়েছে তিনি মুখলেস উদ্দিন। নেত্রকোনা শহরের মসজিদ কোয়ার্টার এলাকায় পাবলিক লাইব্রেরির বিপরীতে তাঁর চায়ের দোকান। নামা ‘কবি মামার চায়ের দোকান’। রাস্তার ঠিক পাশেই প্রায় চার হাত বাই দশ হাতের একটি ঘর। এই ছোট্ট ঘুপছি ঘরটিই এখন নেত্রকোনা শহরের সবচেয়ে পরিচিত চায়ের দোকান। আগে রাস্তার উপরেই বসতেন। সম্প্রতি রাস্তা উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে উঠেছেন এখানে। স্বল্প পুঁজি, তাই ছোট্ট ঘর।
ঘর ছোট হলে কী হবে? কাস্টমারের কমতি নেই। সদালাপী, বিনয়ী আর হাসিমাখা মুখ নিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষটি সদা ব্যস্ত চা বানাতে আর সরবরাহ করতে। একটি ছোট্ট লাল চায়ের দোকান নিয়ে বসা মুসলিম উদ্দিনের গল্পটি একটু অন্যরকম। নেত্রকোনা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা মাওলানা তমিজ উদ্দিনের ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। অন্য সব ভাইবোন লেখাপড়া করলেও তিনি পেরোতে পারেননি প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি। পেরোবেন কি করে? তাঁর মাথায় যে ‘আউট বই’ পড়ার পোকা! উত্তীর্ণ কৈশরে কবিতা লেখার সর্বনাশী নেশা! সে নেশায় বুঁদ হয়ে তিনি শুধুই পড়েছেন আর লিখেছেন। তাঁর লেখা গল্প-কবিতা এক সময় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে নেত্রকোনার বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকায়। পড়ালেখা আর সৃজনশীল কাজে কাটতো সময়। কিন্তু সময় কি সব সময় একরকম যায়? একসময় তিনি পড়ে যান নিদারুণ অর্থ দৈন্যে। কিন্তু হাল ছাড়েন নি তিনি। খুলে বসেন চায়ের দোকান।
নিতান্ত কিছু আসবাব দিয়ে শুরু করেন চা স্টল। কিন্তু উদ্ভাবন যাঁর নেশা, তিনি কি দমে থাকতে পারেন? ১০/১২ বছর আগে ‘মামা স্পেশাল চা’ নামে মাল্টা, মধু আর কয়েক পদের মসলা সহযোগে একটি নতুন ধরণের চা তৈরি করেন। কাস্টমারদের পছন্দ হয়। ব্যস, সেই থেকে শুরু। এখন চায়ের পদ এসে দাঁড়িয়েছে ১৬২তে। প্রতিনিয়ত নতুন স্বাদের, নতুন গুণের চা তৈরি করছেন তিনি। স্বোদ্ভাবিত এই সব চা তিনি তৈরী করেন বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে। পরীক্ষা করেন নিজেই। তাঁর মন মতো হলে উপযুক্ত দামে তা কাস্টমারদের পরিবেশন করেন।
তাঁর এই বৈচিত্র মুগ্ধ করেছে শহরের সব প্রান্তের, সব বয়সের, সব শ্রেণির মানুষকেই। ১৬২টি পদের নামসহ মূল্য তালিকা করে টানিয়ে রেখেছেন দোকানে। ক্রেতারা তালিকা দেখে পছন্দ অনুযায়ী নাম বলেন, “আমি নিজে তৈরি করে সরবরাহ করি চা। এ কাজে আমার কোন গুরুও নেই, শিষ্য নেই।” একান্তই স্বোদ্ভাবিত। তবে হ্যা, তাঁর এই চা রন্ধনকলা তিনি লিপিবদ্ধ করছেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁর মৃত্যুর পর বই আকারে প্রকাশিত হলে তাঁর কোন আপত্তি নেই। ১৬২ পদের চায়ের মধ্যে বয়স, রুচি, প্রয়োজন অনুযায়ী বিন্যস্ত আছে চায়ের পদ। দাম নাগালের মধ্যেই। ৫ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত চায়ের দাম। তবে লাভ সীমিত।
শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর এ চা সম্ভার গড়ে তুলেননি। তাঁর পিতা মাওলানা তমিজ উদ্দিন বলেছিলেন: ‘তুমি দুনিয়ার মধ্যে এমন ভালো কাজ করো, যাতে মৃত্যুর পরও মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’ পিতার উপদেশ সারাজীবন মনে রেখেছেন তিনি। আর সৃজনশীলতা তো তাঁর নেশা। দুইয়ে মিলে বিপুল এই চা বৈচিত্র তিনি তৈরি করতে পেরেছেন। তাঁর চায়ে ব্যবহৃত ভেষজ উপাদানগুলো তিনি নিজে সংগ্রহ করেন। ফলের ফরমালিন তিনি এক ঘণ্টার উপরে পানিতে রেখে বিশুদ্ধ করেন। এরপর সঠিক পরিমাণে তা মিশিয়ে পরিবেশন করেন তাঁর ঔষধি গুণাগুন সম্পন্ন এই চা।
মুখলেস উদ্দিনের চায়ের দোকানের নাম ‘কবি মামার চায়ের দোকান’ হওয়ার কাহিনীও অন্যরকম। কবিতা লিখেন বলে তাঁর গুণাগ্রহীরা তাঁকে কবি বলেই ডাকেন। আর চায়ের দোকানদাররা তো এ যুগের উঠতি ক্রেতাদের কাছে মামাই! তাই একই সাথে তিনি কবি, একই সাথে তিনি ‘মামা’! তাঁর অন্যরকম এই চায়ের দোকান নিয়ে ইতিমধ্যেই বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’ সহ কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর অনুভূতি আনন্দের। এ কারণে নয় যে, তাঁর ব্যবসার প্রচার হচ্ছে। তাঁর একটি উদ্ভাবন মানুষের মধ্যে ছায়া ফেলছে এতেই তিনি আনন্দিত।
মুখলেস উদ্দিনের চাওয়া খুব অল্প। তিনি নিজে সদালাপী, হাসি-খুশি মানুষ। অন্যের কাছ থেকেও তিনি তা-ই প্রত্যাশা করেন। না পেলে ব্যথিত হন, মনে মনে কষ্ট পান। তবে কাউকে বলেন না কিছুই। ম্যাক্সিম গোর্কি, হুমায়ূন আহমেদ, হেলাল হাফিজ, নারায়ণ গোস্বামী তাঁর প্রিয় সাহিত্যিক। তাঁর লেখা নাটক ‘কেমন চলছে’ মঞ্চস্থ হয়েছে একাধিকবার। এখনো মনে কষ্ট এলে ফিরে যান বইয়ের কাছে, গল্প পড়েন, কবিতা পড়েন।
তাঁর সংসারে স্ত্রী নূরজাহান আক্তার, মেয়ে প্রমী আর ছেলে মোশারফ। মেয়ে দত্ত স্কুলের দশম শ্রেণি আর ছেলে এবার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
মুখলেস উদ্দিন চান তাঁর উদ্ভাবনী এই কর্মটিকে আর একটু বড়ো পরিসরে করতে। হালকা বৃষ্টিপাতেই বন্ধ হয়ে যায় তাঁর চা বিক্রি। একটু ভালো পরিবেশে ব্যবসার জন্য প্রয়োজন অর্থের। দৈন্যদশাগ্রস্ত মুখলেস উদ্দিনের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তবে উদ্ভাবনী পরিকল্পনাবান্ধব সরকার ইচ্ছে করলে সৃজনশীল এই মানুষটির চাহিদা পূরণ হতে পারে। কিন্তু হবে কী?