মুড়ির শব্দে জীবনের ছন্দ
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)
পবিত্র রমজানে ইফতারের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে মুড়ি। বাঙালি সারাবছর মুড়ি খেলেও ইফতারে মুড়ির কদর অনেক বেশি। ইফতারিতে ছোট-বড় প্রায় সবারই অন্যতম আকর্ষণ পিয়াজু, ছোলার সাথে সু-স্বাদু মুড়ি মাখা। তবে যেনো তেনো মুড়ি হলে কি আর তৃপ্তি পাওয়া যায় ? চাই ভেজাল মুক্ত হাতে ভাজা সুগন্ধী মুড়ি। আর এই মুড়ির স্বাদ উপভোগ করতে হলে ছুটে যেতে হবে গ্রামে। গ্রামের গৃহিনীদের হাতে ভাজা স্বাদে ভরপুর ও সুগন্ধ এই মুড়ির কদর সারাবছরের চাইতে রমজানে বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তেমনি মানিকগঞ্জের নবগ্রাম ইউনিয়নের নবগ্রাম, ধলাই, উভাজানি, সরুপাই ও দৌলতপুর উপজেলার পূর্ব পাড়া গ্রামের গৃহবধুরা পরম মমতা দিয়ে এই মুড়ি তৈরি করছেন কয়েক যুগ ধরে। ভুষি দিয়ে ধান থেকে তৈরি হয় বড় আকারের মুড়ি। এই মুড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে রাজধানীসহ দেশজুড়ে। এসব এলাকার গৃহীনি ও বাড়ির কর্তাদের এখন যেন দম ফেলার সময় নেই।
গত শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার সরুপাই, ধলাই, ওভাজানী ও নবগ্রামে তৈরি হচ্ছে হাতে ভাজা এই মুড়ি। প্রায় ৩৫ বছর ধরে এই গ্রামগুলোতে তৈরি হয় ভেজালমুক্ত হাতে ভাজা মুড়ি। মুড়ি তৈরি একমাত্র পেশা তাদের। মুড়ি ভেজেই তাদের জীবিকা চলছে। সংসারের-আয় উন্নতি করেছেন অনেকেই। কিন্তু পুঁজির অভাব ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছে না হাতে ভাজা মুড়ির কারিগররা। বাধ্য হয়ে অনেকেই ছেড়ে দিচ্ছেন এ পেশা। তারা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, “মুড়িকে আকর্ষণীয় ও আকারে বড় করতে শহরের ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে ক্ষতিকারক হাইড্রোস।”
ধলাই গ্রামের প্রায় ১০/১২ বাড়িতে মুড়িকে ঘিরেই চলছে ব্যস্ততা। কেউ লাকড়ি এগিয়ে দিচ্ছেন, কেউ মুড়ির চাল শুকাচ্ছেন, কেউবা বিশেষ ধরণের মাটির তৈরি চুলায় খোলায় চালে উত্তাপ দিচ্ছেন। গরম বালুর পরশে তা মুড়মুড় করে ফুটে তৈরি হচ্ছে সুস্বাধু মুড়ি। প্রতিটি বাড়িতে মুড়ির তৈরির শব্দ যেন জীবনের ছন্দ জড়িয়ে আছে তাদের।
এদিকে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার প‚র্বপাড়া গ্রামের গৃহবধ‚রা এখন মুড়ি ভাজায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাদের হাতে ভাজা মুড়ির দাম বেশি হলেও সুস্বাদু হওয়ায় জেলা শহরের গন্ডি পেরিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে এ মুড়ি। সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার দৌলতপুর প‚র্বপাড়া, ঝর্ণা রানী শীল, কালীতারা রাজবংশী, শ্যামলী রানী রাজবংশী, সাধন রাজবংশীর বাড়িতে চলছে মুড়ি তৈরির ধুম। প্রথম রমজান থেকে প্রতিদিন তারা দুই থেকে চার মণ মুড়ি মাটির চুলোয় ভেজে বিক্রি করছে। তারা জানান, বাজারে সার দিয়ে মেশিনে ভাজা মুড়ির দাম কম ও এতে সময় কম ব্যয় হওয়ায় হাতে ভাজা মুড়ির বেচাকেনা অনেক কমে গেছে।
চালের সঙ্গে লবণ পানি মিশিয়ে বালু দিয়ে ভেজে এই মুড়ি তৈরি করা হয়। জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে রয়েছে এই মুড়ির ব্যাপক চাহিদা। যারা মুড়ি তৈরি করেন তাদের বিক্রি নিয়ে কোনো ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় না। কারণ পাইকাররা তাদের বাড়ি থেকে এই মুড়ি কিনে নিয়ে যায়। সারাবছর ধরে নারী-পুরুষ মিলেমিশে চালায় পারিবারিক ব্যবসা। মুড়ি ভাজার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি পরিবার এখন মোটামুটি সচ্ছল। তাদের অনেকের বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। বিশেষ করে যেখানে তারা মুড়ি ভাজার কাজ করেন সেখানের পরিবেশও স্বাস্থ্যসম্মত।
মানিকগঞ্জ-হরিরামপুর সড়ক সংলগ্ন সরুপাই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আনোয়ারা বেগমের বাড়িতে হাতে ভাজা ভুষিভাঙ্গা মুড়ির ময়ময় গন্ধ। পরিবারের সবাই ব্যস্ত মুড়ি তৈরির কাজে। প্রথম রমজানের দুই এক দিন আগে থেকে প্রতিদিন তারা দুই থেকে চার মণ মুড়ি মাটির চুলোয় ভেজে বিক্রি করছে। পাইকাররা এখান থেকে মুড়ি ক্রয় করে জেলা শহরের বড় বড় দোকানে নিয়ে বিক্রি করে থাকে। এছাড়া এই অঞ্চলের সুস্বাদু মুড়ির কদর এতোই বেশি যার ফলে জেলার গÐি পেরিয়ে তা চলে যাচ্ছে ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। শুধু আনোয়ারা বেগমের বাড়িতেই নয় এই গ্রামের কমপক্ষে আরো ১২টি বাড়িতে চলছে মুড়ি তৈরির ধুম। আনোয়ারা বেগম বললেন, “স্বামীর সংসারে যেদিন পা রেখেছি সেদিন থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি মুড়ি তৈরিতে। ৩৫ বছরের অধিক সময় ধরেই মিশে আছি মুড়ি ভাজার কাজে। ফলে মুড়ি তৈরি ও বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা পেয়েছি। আমার বাড়ির হাতে ভাজা মুড়ির নাম ডাক অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছে।”
তিনি বলেন, “হাতে ভাজা মুড়ির কদর সব চাইতে বেশি থাকে রমজান মাসে। এই মাসে প্রতিদিনই পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে মুড়ি কিনে তা শহরে বেশি দামে বিক্রি করে আসছে। আমরা যে মুড়ি তৈরি করি তাতে কোনো ধরনের ভেজাল নেই। নেই কোনো রাসায়নিক ক্ষতিকারক পদার্থ। যার কারণে হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা বেশি। তবে সারাবছরের চাইতে রোজার সময় এর চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। প্রতি কেজি বিক্রি করি ৯০ থেকে একশ টাকা। অনেক কষ্ট হয় তারপরও প‚র্ব পুরুষের এই পেশাকে ছাড়তে পারি না।”
এ গ্রামের গৃহবধূ হাজেরা বেগম বললেন, “আমরা এখানে যে মুড়ি ভাজি তার নাম ভুষিভাঙ্গা মুড়ি। হাতে ভাজা এই মুুড়িতে নেই কোন ক্ষতিকার পদার্থ। যে কারণে এই মুড়ির চাহিদা অনেক বেশি। অপর মুড়ি তৈরির কারিগর মো. ইউনুছ মিয়া জানান, ভুষিভাঙ্গা মুড়ির ধান আনতে হয় বরিশাল থেকে। সেখান থেকে প্রতি মণ ধান আনতে খরচ পড়ে যায় ১৩শ’ টাকার ওপরে। এক মণ ধানে ২০ কেজির মতো মুড়ি হয়। হাতে ভেজে মুড়ি তৈরি করতে খুবই পরিশ্রম হয় ঠিকই কিন্ত এই মুড়ি বিক্রি করেই তাদের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। সারাবছরের চাইতে প্রতিবছর রমজান মাসে মুড়ির কদর বেশি থাকে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. মজনু বিশ্বাস জানালেন, এই গ্রামগুলো মুড়ির গ্রাম হিসেবেই এক সময় পরিচিত ছিল। প্রতিটি বাড়িতে মুড়ি তৈরি করা হতো। নিজ জেলা ছাড়িয়ে ঢাকার পাইকাররা যেন হুমড়ি খেয়ে পরেন এ এলাকায় তৈরি মুড়ি কিনতে। অনেকেই শখের বশে দেশের বাইরেরও হাতে ভাজা এই সুগন্ধী মুড়ি নিয়ে যান। একটা সময় বাতাসে ভেসে বেড়াতো মুড়ির সুবাসিত ঘ্রাণ। কিন্তু বর্তমানে বাজারে আধুনিক মেশিন দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে মুড়ি উৎপাদন করায় এখানকার কারিগড়রা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই হাতে ভাজা মুড়ি তৈরিতে আগ্রহ কমে যাচ্ছে তাদের।
বিডিএম (বাংলাদেশ ডিপ্লোমা মেডিকেল এসোসিয়েশন) এর অতিরিক্ত মহা সচিব ডা. মো. আবুল হাসান জানান, প্রতি ১০০ গ্রাম পরিমাণ মুড়িতে রয়েছে ৪০২ গ্রাম ক্যালরি, ৮৯.৮ গ্রাম শর্করা, ০.৫ গ্রাম ফ্যাট, কোলেস্টেরল নেই, ৬.৩ গ্রাম প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ৬ মি.গ্রা.,ফসফরাস- ৬ মি.গ্রা ,সোডিয়াম ৩ মি.গ্রা.। মানবদেহের জন্য এই পুষ্টিগুণ সর্ম্পর্ণ মুড়ি অনেক সহায়ক ও উপকারী। মুড়ির চাহিদা বাড়ার যান্ত্রিক কলে মুড়ি বানানো ক্রমশই বাড়ছে। বিভিন্ন হাট বাজারে রাসায়নিক সার ইউরিয়া ও ফিটকিরি মিশ্রিত মুড়ি অবাধে বিক্রি হচ্ছে। মানুষ নানা রকম অসুখের শিকার হচ্ছে এ ধরনের খাদ্যের কারণেই। হাতে ভাজা ভেজালমুক্ত মুড়ি খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বানিয়াজুরী বাসষ্ট্যান্ড বাজারের মুদি দোকানি মো. গোলাপ খাঁন জানান, গ্রামের হাতে ভাজা মুড়ি মানুষের কাছে কদর বেশি। সেখান থেকে ৯০ থেকে একশো টাকায় কিনে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। আর রমজান মাসে ইফতারের জন্য এই মুড়ির চাহিদা অনেক বেশি। কারণ এই মুড়িতে কোন ভেজাল নেই।
মানিকগঞ্জ বাসষ্ট্যান্ড আড়তের মুড়ির পাইকারী ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম জানান, ‘রোজার পাশাপাশি বর্তমানে আম, কাঁঠাল বাজারে উঠায় চাহিদা বেড়েছে হাতে ভাজা মুড়ির। স্বল্প পুঁজির এ ব্যবসা হলেও প্রতিদিন প্রায় এক লাখ টাকার মুড়ি বিক্রি হয় স্থানীয় এ আড়তে। এছাড়াও এসব গ্রাম থেকে ট্রাকে করে রাজধানী ঢাকা ও আশুলিয়ার বিভিন্ন পাইকারী আড়তে চলে যায়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়।
স্বল্প পুঁজির এই ব্যবসা করে মানিকগঞ্জের এসব গ্রামের মানুষরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও স্থানীয় কোনো ব্যাংক এগিয়ে আসেনি তাদের পাশে। স্বল্প সুদে এসব মুড়ি উৎপাদনকারীদের ঋণ সহায়তা করলে ব্যবসার পরিধি বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন মুড়ি উৎপাদনকারীরা। তাদের দাবী সরকার তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে তারা বেশি করে মুড়ি উৎপাদন করতে পারতো।