ধলেশ্বরী: একটি মৃতপ্রায় নদীকে বাঁচানোর উদ্যোগ
মানিকগঞ্জ থেকে বিমল চন্দ্র রায়
ভূমিকা
বাংলাদেশের সরকার নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। দেশের বিভিন্ন নদীকে দখল, ভরাটের হাত রক্ষা করা এবং মৃতপ্রায় নদীগুলোকে বাঁচানোর জন্য সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে। তবে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করার পরও আমাদের দেশে নদী দখল ও দূষণ কমেনি এখনও। নদী আমাদের বিভিন্ন ধরনের উপকার করে যাচ্ছে কিন্তু বিনিময়ে আমরা নদীগুলোকে ধ্বংস করে তাদেরকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে দিয়েছি। মানিকগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী তার মধ্যে অন্যতম। একসময় এই নদী ছিলো প্রবল ¯্রােতস্বিনী কিন্ত আজ এ নদী প্রায় মরে যেতে বসেছে। এই নদীকে বাঁচানোর জন্য বারসিকসহ মানিকগঞ্জের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজ নানাভাবে আন্দোলন করেছেন। নানান আন্দোলন, সভা ও মতবিনিময়ের ফলে ধলেশ্বরী নদীকে বাঁচানোর দৃশ্যমান উদ্যোগ আজ পরিলক্ষিত। এ নদীর ৪৫ কিলোমিটার গতিপথ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ বছরের শুরুতে। তবে এ বিষয়ে আলোচনার আগে নদী সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
নদী
পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ সমতল নয়। নদী ভূ-পৃষ্ঠের উচুতম স্থানে বর্ষণসৃষ্ট জলধারা ঢালুতম পথে একাধিক ঢাল পরিচ্ছেদনের ফলে সৃষ্ট অবতল-নিচু অংশে প্রবাহিত হওয়ার প্রবণতা প্রর্দশন করে। নদী গঠনের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত আয়তন ও গতিবেগসম্পন্ন একাধিক প্রবাহের মিলিত ধারা যা অন্তঃস্থভূমি ও শিলাকে ক্ষয় করে খাতের সৃষ্টি করে এগিয়ে যেতে পারে। নদীর একটি উৎস আধার থাকে যা নদীকে নিয়মিত প্রবাহ যোগান দেয়। নদী যে অঞ্চলে উৎপত্তি লাভ করে তাকে নদীর উৎসস্থল বলে। গঙ্গা নদীর উৎস হিমালয়ের গঙ্গোত্রী নামক হিমবাহ এবং ব্রহ্মপুত্র নদের উৎস মানস সরোবর। উৎস থেকে ভিত্তিতলে প্রবাহিত গতিপথে নদী আঁকাবাঁকা সর্পিলপথ ও বাঁকের সৃষ্টি করে মোহনার দিকে চলতে থাকে। নদীর গতিপথে জলরাশির গতিবেগ বাধাপ্রাপ্ত হলে অথবা নদীর জলরাশি দুকূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হলে নদী কর্তৃক পরিবাহিত ভার বা বস্তুকণার অংশবিশেষ নদীর তলদেশে অথবা নদীখাতের দুইপাড়ে সঞ্চিত হয়। এভাবেই নদীর সঞ্চয়কার্যের ফলে বদ্বীপ, প্লাবনভূমি, চর এবং পলিজ পাখা ও পলিজ কোণ প্রভৃতি ভূমিরূপ গড়ে উঠে।
প্রথাগতভাবে নদীর অবস্থানগত ধাপ অনুসারে যৌবন, পরিণত এবং বার্ধক্য এ তিন শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা হয়ে থাকে। উপত্যকার অংশ যৌবন অবস্থা, মধ্যভাগ পরিণত অবস্থা এবং বার্ধক্য অবস্থায় নদী সমতলে উপনীত হয় এবং প্রশস্ত সমতল অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীই বার্ধক্য পর্যায়ে পেঁৗঁঁচ্ছে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। নদীপথে যাতায়াত সুবিধা এবং নদী উপত্যকাসমূহের পলিমাটি উৎকৃষ্ট কৃষিভূমি হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতাসমূহ নদী উপত্যকায় গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নদীমালা গর্বের। প্রায় ৭০০টি নদী-উপনদীর সমন্বয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদী ব্যবস্থা এখানে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নদ-নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪১৪০ কি.মি.। বাংলাদেশের নদীমালাকে চারটি প্রধান নদী ব্যবস্থা বা নদী প্রণালীতে বিভক্ত করা হয়েছে : (১) ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী প্রণালী (২) গঙ্গা-পদ্মা নদী প্রণালী (৩) সুরমা-মেঘনা নদী প্রণালী (৪) চট্রগ্রাম অঞ্চলের নদীসমূহ।
ধলেশ্বরী নদীকে বাঁচানোর উদ্যোগ
যমুনা নদীর একটি শাখা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদী। বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং মুন্সিগঞ্জ জেলায় এ নদী প্রবাহিত। এ নদীটির দৈর্ঘ্য ২৯২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৪৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়নবোর্ড ‘পাউবো’ কর্তৃক ধলেশ্বরী নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রিয় অঞ্চলের নদী নং-২৭। নদীটি মূলত বাংলাদেশের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত একটি জলধারা। মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার বরাইদ গ্রাম দিয়ে মানিকগঞ্জ সদর, সিংগাইর উপজেলার শতাধিক গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঢাকা জেলায় প্রবেশ করে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর ভাঙা গড়ার পরিণতিতে ধলেশ্বরী নদী পলি পড়ে নাব্যতায় হারিয়ে সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লি গ্রামের থেকে পরবর্তী অংশ নালায় পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের পরিবেশ সচেতন, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকবৃন্দ, উন্নয়নকর্মীর উদ্যোগে ‘ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন’ নামে সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নানান স্তরে নদী রক্ষায় আলোচনা, মতবিনিময়, সভা, সমাবেশ করে আসছে। জনপ্রতিনিধিগণ ধলেশ্বরী নদী রক্ষার বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেন। ফলশ্রুতিতে সরকারের নদীর খননের উন্নয়ন উদ্যোগে ২০২০ শুরুতে নদীর ৪৫ কিলোমিটার গতিপথ খননের জন্য টাকা বরাদ্দ করে এবং করোনাসহ নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে খননের কার্যক্রম চলমান আছে।
বারসিক মানিকগঞ্জ ধলেশ্বরী নদী বাচাঁও আন্দোলনের সমন্বয়কারির ভূমিকা পালন করে। নদী ও পানি বিষয়ে সরকারে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও নৌ মন্ত্রণালয় অধীনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও নদী গবেষণা ইনষ্টিটিউটসহ অনেকগুলো অধিদপ্তর,পরিদপ্তর, কর্তৃপক্ষ ও বোর্ড কাজ করছে। নদী গবেষণা ইনষ্টিটিউট এর কার্যালয় ফরিদপুরে। বারসিক প্রতিনিধিরা গত সপ্তাহে নদী গবেষণা ইনষ্টিটিউট কার্যালয়ে গিয়ে বাংলাদেশের নদী সর্ম্পকে ধারণা লাভ করেন।
‘নদী বাঁচায় প্রাণ-প্রকৃতি নদীর প্রাণ রক্ষা চাই’-এই শ্লোগান বা চাওয়া স্বার্থক হউক। বাংলাদেশের সকল নদী স্বাভাবিক গতিপথে প্রবাহিত হয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইতিহাস ঐহিত্য রক্ষা পাক।
তথ্যসহায়তা: বাংলাপিডিয়া, পাউবো ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়।