সন্তানদের পড়া লেখা চালিয়ে যেতে আমরা শ্রম বিক্রি করছি
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
প্রায় প্রতিটি মানুষই তার আপন অবস্থানে সন্তষ্ট নয়। তাই তারা প্রতিনিয়ত উপরে ওঠার সিড়ি খোঁজেন। বর্তমান অবস্থার উন্নয়নে সচেষ্ট থাকে। ধনী ও গরিব সবার মাঝে উপরে ওঠার, প্রজন্মের উন্নয়নের প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ্য করি। গত রবিবার ৭ জন নারী শ্রমিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা কিভাবে উপরে ওঠার চেষ্টা করছেন। কিভাবে কায়িক পরিশ্রম করে তারা ভবিষ্যত প্রজন্মের উন্নয়ন ঘটাতে চান। কেন তারা শ্রম বিক্রি করছেন।
পাবনার চাটমোহরের বিলচলন ইউনিয়নের দোলং গ্রামের ওমেলা খাতুন, পারভীন, লিপি খাতুন, শাহনাজ খাতুন, নজেদা খাতুন এবং বোঁথর গ্রামের সেলিনা পারভীন ও মৌসুমী খাতুন নামক ৭ জন নারী শ্রমিক গত ১৮ নভেম্বর চাটমোহরের বোঁথর গ্রামের উত্তরের বিলে রসুন লাগাচ্ছিলেন। সবার বয়স সাতাশ থেকে চল্লিশের ভেতর। তাদের সাথে আলাপচারিতায় যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেটি হলো, তারা কেবল পেটের খাবারের জন্য নয় বা সংসারে সহায়ক ভূমিকা রাখতে নয় তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের উন্নয়ন ঘটাতে চান। সারা দিন রোদের ভিতর কাজ করে তারা রোজ যে তিনশ’ টাকা পারিশ্রমিক পাচ্ছেন এ টাকা তারা তাদের সন্তানদের পড়ালেখার পেছনে খরচ করতে চান। নিজেরা পড়া লেখার সুযোগ না পেলেও তাদের সন্তানেরা যেন এ সুযোগ পায় এটিই তাদের প্রত্যাশা।
পারভীনের ছেলে নাজমুল স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। মেয়ে নিরালা তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। সেলিনার স্বামী গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগেই। তার দুই ছেলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিচ্ছে। লিপি খাতুনের ছেলে রিপন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ষষ্ট শ্রেণীর ছাত্র। মৌসুমীর ছেলে মহরম অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে এবং মেয়ে রহিমা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিচ্ছে। শাহনাজের বড় ছেলে নাটোরে তার খালার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করছে। সে এখন ষষ্ট শ্রেণীর ছাত্র। দ্বিতীয় ছেলে মিজান (চতুর্থ শ্রেণী)সহ অন্য দুই মেয়ে (প্রথম শ্রেণী) চাটমোহরের ছাইকোলা এলাকায় তাদের নানার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করছে। নজেদা খাতুন ইতিমধ্যে তার বড় মেয়েকে কষ্টে শিষ্টে বিয়ে দিলেও দ্বিতীয় মেয়ে হুমায়রা পড়ালেখা করছে। আর ওমেলা খাতুনের এক ছেলে এক মেয়ে। তারা ও স্থানীয় বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। এদের প্রত্যেকের যে বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে সেটি হলো প্রত্যেকের ছেলে মেয়ে স্কুলগামী। বিধবা সেলিনা ব্যতিত অন্যদের স্বামীরা শ্রমজীবী। এদের কেউ মধ্যে কেউ কৃষি কাজ, কেউ ইটের ভাটায় আবার কেউ অন্য পেশায় জড়িত থেকে কষ্টে শিষ্টে সংসার চালাচ্ছেন। সবাই অভাবী পরিবারের মানুষ।
আশার কথা এরা সবাই একই মানসিকতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করতে চাই। এজন্য কাজের সময় আমরা অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করি। সংসারের উপার্জনক্ষম পুরুষের পক্ষে একা সংসার চালিয়ে ছেলে মেয়েদের স্কুলের বেতন পোষাক পরিচ্ছদ কিনে দেওয়া, প্রাইভেট পড়ানোর খরচ জোগানো কষ্টকর। ওদের এসকল প্রয়োজন মেটাতে না পারলে ওদের পড়া লেখা বন্ধ হয়ে যাবে।’ তারা আরও বলেন, ‘ওরা ও হবে আমাদের মতো শ্রমিক। রসুন রোপনের সময় এ এলাকায় শ্রমিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এসময় ধান কাটা, রবিশস্য আবাদ, ধানের জমি থেকে নাড়া কাটাসহ বিভিন্ন কাজ লেগেই থাকে। পারিশ্রমিক পুরুষের তুলনায় কম হওয়ায় এসময় কয়েকদিনের জন্য কদর বাড়ে নারী শ্রমিকের। আমরা ভোর ৪ টার দিকে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির রান্নাসহ অন্যন্য কাজ শেষ করে ৭ টার মধ্যে মাঠে চলে আসি। দুপুরে কিছু সময়ের জন্য বিরতি পাই। বিকেল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করে বাড়ি ফিরে আবার রাতের রান্নার কাজে মনোনিবেশ করি।’
সারাদিন কাজ করলে পারিশ্রমিক হিসেবে তাঁরা পান ৩শ’ টাকা। কেবল সংসারে সহায়তা করতে নয় ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা বাড়ির সমস্ত কাজ করে ও মাঠে ঘাটে রোদে পুরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শ্রম বিক্রি করছেন।