সম্মিলিত উদ্যোগে আনে সফলতা
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
এক সময়ের খরস্রোতা ধলাই নদী ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। দুইপাড় ভরাট হয়ে নদীর এই সংকীর্ণ অবস্থার সৃষ্টি, যেন এক লাফেই পাড় হওয়া যাবে। এই সংকীর্ণ নদীতে ভেসে আসা কচুরিপানা পচে পানি এতটাই দূষিত হয়েছে যে, নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। নদীর তীরবর্তী ৫টি গ্রামের মানুষ, যারা নিত্য প্রয়োজনীয় সকল কাজের জন্য এই নদীর উপর নির্ভরশীল ছিল তারা এখন পানির চরম সংকটে পড়েছে। গোসলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে নদীর দূষিত পানি ব্যবহার করতে না পারার ফলে স্থানীয় টিউবওয়েলগুলোতে পানির জন্য অধিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে প্রায়ই টিউবওয়েলগুলো অকেজো হয়ে পড়ছে। এর ফলে টিউবওয়ের ব্যবস্থাপনা খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় মালিকরা অন্যদের পানি দিতে রাজি হয় না। এছাড়াও পানির স্তর দিন দিন আরও নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবয়েল থেকে খাবার জন্য পানি তোলা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। তাই অপারগ হয়ে অধিকাংশ দরিদ্র পরিবার নদীর দূষিত পানি ব্যবহার করায় তাদের মধ্যে সংক্রমণ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগের। পাশাপাশি নদীর পাঁড় ঘেষা প্রতিটি পরিবার বিশেষ করে মইনপুর, চকপাড়া ও রেল কলোনীর প্রতিটি বাড়ির লোকদেরকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মশার কামড়ে। ফলে গ্রামে ম্যালেরিয়া ও টাইফয়েড রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নদী সংকীর্ণতা ও পানি কমে যাওয়ার ফলে প্রাকৃতিকভাবে নদীতে উৎপাদিত খাদ্য উৎসগুলোও কমে আসছে, কমে গেছে স্থানীয় জাতের মাছ ও জলজ উদ্ভিদ। নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় কর্মহীন সময় কাটাছে ধলাই পাড়ের ছোট ছোট জেলে পরিবারগুলোর। জেলেরা ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে মাছের সন্ধানে সারা বেলা ঘুরে বেড়ালেও মাছের দেখা পায়না বললেই চলে। বেলা শেষে খাবারের জন্য মাছও মেলেনা। ফলে স্থানীয় বাজারগুলোতেও স্থানীয় জাতের মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। দরিদ্র জেলে পরিবারগুলো অর্থনৈতিকভাবে আরও দরিদ্র হয়ে পড়ছে।
এমনি নানা সমস্যার মুখোমুখি যখন হাজারও মানুষ তখন মইনপুর গ্রামের স্থানীয় কিছু সবুজ চিন্তার মানুষ এগিয়ে আসেন এ সমস্যা সমাধানে। তারা গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলে কচুরিপানা পরিস্কার করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নদীর এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিভিন্ন পেশা ও বয়সের অর্ধশতাধিক লোকের (কৃষক, জেলে, যুব) অক্লান্ত পরিশ্রমে কচুরিপানা পরিস্কার করা হয়। পরিষ্কার করার কাজে মূল ভূমিকা পালন করে স্থানীয় জেলেরা, যাদের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল এই নদীর উপর।
নেত্রকোনার অন্যান্য নদীর তুলনায় ধলাই নদীর মাছ একসময় খুবই সুস্বাদু ছিল। শীত ও বর্ষা দুই মৌসুমে দুই পাড়ের লোকেরা নদী থেকে প্রতিদিন মাছ ধরে পরিবারের সদস্যদের আমিষের চাহিদা মেটাত। এ বিষয়ে এলাকার কৃষক মো. আ. বারেক মিয়া বলেন, “চার-পাঁচটি শিং মাছ দিয়ে এক বেলার তরকারি রান্না করা যাইত, একবার ভাত খাইলে মুখে মাছের গন্ধ মুখে লাইগা থাকত”। তিনি বলেন, “বর্ষা মৌসুমে বর্শি দিয়ে দুই পাড়ের ছোট বড় সকলেই মাছ সংগ্রহ করত, বোয়াল মাছ ধরার নেশায় গ্রামের বাড়ির অধিকাংশ পুরুষ লোকেরা রাত কাটিয়েছে নদীর পাড়ে বসে। রাত শেষে প্রত্যেকে দু’-তিনটি বোয়াল মাছ নিয়ে গাল ভরা হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। এখন ধলাই নদীর কয়েক কিলোমিটার জুড়ে জাল টেনেও রান্নার জন্য মাছ সংগ্রহ করতে পারছে না স্থানীয় জেলেরা।”
নদীর পানি পরিস্কার করার সাথে সাথে বদলে গেছে দুই পাড়ের প্রাণবৈচিত্র্য, প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এখন দেশী হাঁস ও রাজ হাঁস পালন শুরু করেছে। এতে করে এলাকার মানুষের খাদ্য তালিকায় পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে এবং পাশাপাশি নারীরা অথনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। দরিদ্র পরিবারের নারীরা তাদের সন্তানদের শিক্ষা খরচ বহনে বেগ পেতে হচ্ছে না। হাঁসের ডিম ও হাঁস বিক্রি করে সহজেই সন্তানদের শিক্ষার এসব খরচের যোগান হচ্ছে।
গ্রামের এসব সবুজ চিন্তার লোকেরা এর পূর্বেও চলাচলের জন্য বাঁশ ও কাঠের সাঁকো তৈরি করা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও সংস্কার, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধান করে গ্রামটিকে একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করে যাচ্ছে। তাদের এই ধরণের সামাজিক ও পরিবেশের উন্নয়ন উদ্যোগ অন্য গ্রামের লোকদেরও এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করছে।