বাঁশঝাড়ই আরফান আলীর ব্যাংক
কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
‘আমি ব্যাংকে টাকা রাখি নাই; বাঁশঝাড়ই আমার ব্যাংক। বাঁশ বিক্রি কইরাই আমি চলি। বাচ্চাগুলারে সবকিছু ভাগ কইরা দিছি কিন্তু বাঁশঝাড় ভাগ করি নাই। বাঁশঝাড় থাকাতে একলা থাকলেও আমার কোন কিছুর অভাব নাই। আমি সুখে আছি।” কথাগুলো বলেছেন কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের প্রবীণ আরফান আলী, যার বয়স ১০০ বছর বলে জানিয়েছেন।
মহাঢেউ নদীর তীরে প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার জুড়ে বাঁশঝাড় রয়েছে। এই বাঁশঝাড় নদীর পাড় ভাঙা রোধ করে কৃষকের কয়েক হাজার একর ফসলী জমি রক্ষা করছে। এ বাঁশঝাড় প্রবীণ আরফান আলীল সৌজন্যে আজ মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে। বাঁশঝাড়কে নিজের সন্তানতুল্য মনে করেন। বাঁশ সংরক্ষণের জন্য তিনি একাকি সংসার করছেন। এ বাঁশঝাড় প্রথমে তিনিই শুরু করেছেন মহাদেও নদীর কাছে স্বল্প পরিমাণ জমিতে। এক পর্যায়ে তিনি দুই একর জমিতে বাঁশ রোপণ করতে শুরু করেন যার দৈর্ঘ্য প্রায় দুই কিলোমিটার। এ বাঁশঝাড়ে সর্বমোট কতগুলো বাঁশ রয়েছে তা সঠিকভাবে বলতে না পারলেও আরফান আলী ধারণা করেন ৬০-৭০ হাজার কম হবে না! মানুষ লক্ষ্য করেন যে, এ বাঁশঝাড় নদীর ধারের ফসলি ক্ষেতকে বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা করে। এছাড়া আরফান আলী বাঁশ বিক্রি করে নিজে যেমন এ প্রবীণ বয়সেও স্বচ্ছল জীবনযাপন করেন, কারও ওপর নির্ভরশীল নন ঠিক তেমনি অনেকের জন্য কর্মসংস্থানও তৈরি করেন। তাই তার কাছ থেকে অনেকে বাঁশ নিয়ে নদীর পাড়ে রোপণ করতে শুরু করেন। এভাবে একে একে অনেকে বাঁশ রোপণ করায় বর্তমানে প্রায় ৩-৪ কিলোমিটারজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এ বাঁশঝাড়টি। বর্তমানে এই বাশঁঝাড়ই নদী ভাঙন রোধ করছে, রক্ষা করেছে অনেকের বসতভিটা ও ফসলী জমি। এই বাঁশঝাড় না থাকলে নদীর পাড় ভেঙে ওপারের সব জমি বালুতে ভরাট হয়ে যেতো।
কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের বরোয়াকোনা বাজারে মহাঢেউ নদীর পাশে তিনি বাস করেন আরফান আলী। স্ত্রী আমেনা খাতুন ১০ বছর আগে মারা গেছেন। তারপর থেকেই তিনি ১০-১২ বছর ধরে একা বসবাস করছেন। বাজারে তার ২০ হাত দৈর্ঘ্য ও ১৫ হাত প্রস্থ্যের একটি হাফবিল্ডিং ঘর আছে। একটি কক্ষ দোকানের জন্য ভাড়া দিয়েছেন। দোকান থেকে প্রতিমাসে ভাড়া পান। ঘরে তিনি সৌরবিদ্যূৎ ব্যবহার করেন। আরেকটি কক্ষ তৈরি করার জন্য খুঁটি গেড়ে রেখেছেন। বাঁশ বিক্রির টাকা দিয়েই সেই কক্ষ তৈরি করবেন বলে জানালেন। বর্তমানে তিনি যেখানে আছেন এটিই ছিল তাদের পুরনো ভিটে। একসময় এই ভিটে ছেড়ে নদীর অপর পারে মৌতলা গ্রামে বসতি গড়তে হয়েছে তাদের। কারণ এই পুরনো ভিটে পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। আজ থেকে ১২-১৫ বছর পূর্ব থেকে পুনরায় প্রাকৃতিকভাবেই আবার নদীর এপারে চর হতে শুরু করলে তিনি পুনরায় তার পুরনো বসতভিটে ফিরে পান। তার ৫ সন্তানকেই তিনি জমি ও অন্যান্য সম্পদ সমানভাবে ভাগ করেছেন। তবে বাঁশঝাড়টি তিনি কারও সাথে ভাগাভাগি করেননি।
শতবর্ষী এই প্রবীণ এখনও কারও উপর নির্ভরশীল নয়। লাঠি ছাড়াই চলতে পারেন, চোখের কোন সমস্যা নেই পরিস্কার দেখতে পান সবকিছু। কানেও কোন সমস্যা নেই শুনতে পান স্পষ্ট। এখনও তিনি নিজে বাজার করেন, রান্না করেন, মাছ কাটেন। রান্না ছাড়া বাকি সময়টা কাটে বাজারে আড্ডা দিয়ে, দোকানে আসা সব বয়সের মানুষের সাথে গল্প করে, বালু ও পাথর উত্তোলোনকারীদের তদারকি করে। আরফান আলীর বাঁশঝাড়ে রয়েছে ৪ (মরাল, বরাগ, উড়া, কেইট্টা) জাতের বাঁশ। তার মধ্যে বরাগ বাঁশের চাহিদা সব থেকে বেশি এবং দামও বেশি। একেকটি বাঁশের রয়েছে একেক গুণ। সব বাঁশ দিয়ে সব কাজ হয় না। মরাল বাঁশ দিয়ে দাঁড়ি, পাতি, বাইরসহ কুটির শিল্পের পণ্য তৈরি করা হয়। অন্যদিকে বরাগ, কেই্ট্টা, উড়া বাঁশ দিয়ে ঘরের পালা, বেড়া, খাপ, বাঁশের সাকো প্রভৃতি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি বাঁশের মূল্য ১০০-২৫০ টাকা। বাঁশ বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি বাজারে ঘর তৈরি করেছেন, প্রতিদিন খরচ করছেন, তার মতো প্রবীণ দুঃস্থদের কেউ সাহায্য চাইলে তাদেরকেও সাহায্য দিচ্ছেন, নাতি নাতনি, মসজিদ ও মাদ্রাসায় সহযোগিতা করেন এবং ছেলেরা চাইলে তাদেরকেও সহযোগিতা করেন বলে তিনি জানান।
বিগত ৫-৬ বছর থেকে মহাদেও নদী থেকে পাথর, বালু উত্তোলনের কাজ শুরু হয়েছে। বালু উত্তোলনের ফলে তার বাঁশঝাড়ের নিচের মাটি সরে গিয়ে নদীতে পড়ে যাবার উপক্রম হয়। তাই বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য প্রতিবাদ জানালেও কোন কাজ হয়নি দেখে তিনি আরফান আলী স্থানীয় সাংসদের শরণাপন্ন হন। অপরিকল্পিত উপায়ে বালু উত্তোলনের কারণে কীভাবে বাঁশঝাড়সহ ফসলী জমিতে নদীতে তলিয়ে যেতে পারে সেই বিষয়টি সাংসদকে জানান। সাংসদের হস্তক্ষেপে তিনি বাঁশঝাড়সহ অন্যান্যদের ফসলী জমি রক্ষা করতে সমর্থ হন। এভাবে তিনি আগলে রেখেছেন তার নিজের সহ অন্যান্যদের বাঁশঝাড়।
এই বাঁশঝাড়টি শুধুমাত্র মানুষের উপকার করেনি; উপকার করেছে এলাকার পাখিসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর! দোয়েল, মুনমুননিয়া, বুলবুলি, চন্না শালিক, শালিক, বক, পানি হাঁস, মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, চিল, হলদে পাখি, কবুতর, কোকিল, বাবুই, শালিক, কাক, টিয়া, ইষ্টি কুটুম প্রভৃতি জাতের পাখিগুলো এই বাঁশঝাড়কে তাদের ‘নিরাপদ আবাসস্থল’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। বাঁশঝাড়ের আশে পাশে রোপণ করা বিভিন্ন জাতের (আম, জাম, পেয়ারা, বড়ই, জাম্বুরা, কাঠাল, জলপাই, লেবু, তাল, খেঁজুর, কলা, ধাতই, মধুবন) দেশীয় ফল পাখি ও এলাকার শিশু কিশোররা খাচ্ছে।
আরফান আলী নিজে ফল খেতে না পারলেও তাঁর লাগানো গাছের ফল অন্যদের খাবার উৎস হওয়াতেই তিনি সন্তুষ্ট। তিনি এখনও বাজার থেকে ফল গাছের চারা ক্রয় করেন এবং নাতি নাতনীদের নিয়ে রোপণ করান। তার সন্তানরাও তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৃক্ষ রোপণ করেন। আরফান আলীর এই অভিনব উদ্যোগ অন্যান্যদের উৎসাহিত করবে নিশ্চয়!