কুকুরগুলোর প্রাণসত্তা রক্ষা জরুরি
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
৫ এপ্রিল ২০১৮। সকাল নয় টা। চাটমোহর পৌর সদরের থানার পেছনের রাস্তায় একটি কুকুর পরে থাকতে দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। কাছাকাছি গিয়ে দেখি তখনও কুকুরটির শ^াস প্রশ^াস কোন মতে চলছে। নিস্তেজ কুকুরটিকে প্রথমে মৃত মনে হলেও পরে নিশ্চিত হই তখনো মৃত্যু হয়নি কুকুরটির। রোগাক্রান্ত কুকুরটির গা থেকে প্রচন্ড গন্ধ ছড়াচ্ছিল। পঁচে যাওয়া অংশে কিলবিল করছিল পোকা। জানলাম, পোকার খাদ্যে পরিণত হওয়া জীবিত কুকুরটিকে নিয়ে বিব্রত পাশের দোকানীরা ইতোমধ্যেই কুকুরটিকে মৃত ভেবে ভাগারে ফেলতে পৌরসভার সুইপারকে ফোন করে ডেকেছেন। তিন চার মিনিট পরই ময়লাবাহী ভ্যান নিয়ে হাজির প্রথম শেণীর চাটমোহর পৌর সভার এক সুইপার।
কুকুরটি ময়লার ভ্যানে তোলার জন্য সুইপার যখন ভ্যানটি কুকুরের কাছাকাছি নিচ্ছিলেন এমন সময় কুকুরটির লেজ ভ্যানের চাকায় নিচে পরলে উঠে দাঁড়াতে না পারলেও ব্যথা পেয়ে কোন রকমে মাথাটি একটু উঁচু করে কুকুরটি জানান দেয় এখনো মৃত্যু হয়নি তার। পাশের দোকানীরা ও সুইপার কি করবে ভেবে পাচ্ছিলনা। একটু পরে সুইপার বেলচা দিয়ে কুকুরটিকে যখন ভ্যানে তোলার চেষ্টা করছিল তখন প্রাণ বাঁচাতে অনেক কষ্টে কুকুরটি সুযোগ বুঝে পাশের বাগানের দিকে চলে যায়। পরে অপর এক সুইপার কুকুরটিকে দূরে কোথাও ফেলে আসেন বলে জানান পাশের দোকানী বিপ্লব চন্দ্র দাস। পাশর্^বর্তী রেডসান টেইলার্সের সত্তাধিকারী বোঁথর গ্রামের মনসুর আলী বলেন, “প্রতিদিনের মতো সকালে এসে দোকান খোলার সময় দেখি দোকানের সামনে পরে আছে কুকুরটি। প্রথমে কুকুরটিকে মরা মনে হলেও পরে দেখি সেটি তখনও মরেনি। এমন বেশ কিছু অসুস্থ কুকুর চাটমোহরের রাস্তায় চোখে পরে যেগুলো প্রতিনিয়ত রোগ জীবাণু ছড়াচ্ছে। বেওয়ারিশ এ কুকুরগুলোর বিধিসম্মত অপসারণে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
চাটমোহর থানা বাজার এলাকায় অবস্থিত মাছের দোকানগুলোর পশ্চিম পাশের একটি বাড়ির বারন্দায় বসে ধুঁকছিল হলুদ রঙের একটি কুকুর। ব্যাপকভাবে চর্ম রোগে আক্রান্ত হওয়ায় শরীরের রঙ বিবর্ণ হয়ে গেছে কুকুরটির। মলদ্বার অথবা যোনীপথ দিয়ে শরীরের ভেতরের লাল রঙের মাংস পিন্ড বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। প্রাণ যাই যাই এ কুকুরটিরও। মাংস ব্যবসায়ী জামিরুদ্দিন বলেন, “চাটমোহর পৌরসভার প্রায় সর্বত্রই এমন রোগাক্রান্ত বেওয়ারিশ কুকুরের বিচরণ। এটি আমাদের ভাবিয়ে তুললেও কুকুরগুলোর চিকিৎসার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। প্রাণ সত্ত্বার অধিকারী কুকুরগুলোর প্রাণ সংহার হলেও দেখার যেন কেউ নেই।”
চাটমোহরের দোলং মহল্লার ভাষা সৈনিক গৌড় সরকার এর বাড়ির সামনে দেখা মেলে কানের উপরে ঘাওয়ালা এবং প্রায় সারা শরীর চর্মরোগে আক্রান্ত একটি কুকুরের। অন্যান্য কুকুরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত একটু ভালো অবস্থা হলেও নাজুক অবস্থায় উপনীত হয়েছে এটিও। এরকম আরো অনেক কুকুরের দেখা মেলে চাটমোহরের রাস্তায় চলতে। পৌরবাসী পথে চলার সময় এসব কুকুর দেখে বিব্রত হন।
চাটমোহর ডিগ্রী অনার্স কলেজের সমাজ কর্ম বিষয়ের প্রভাষক রাজিবুস সামস্ পিজুস বলেন, “চাটমোহরে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েছে। ৩ এপ্রিল মঙ্গলবার সকালে একটি সাতবছরের বাচ্চাকে তাড়া করে একটি কুকুর। দৌড়ে ভাগ্য ক্রমে শিশুটি রক্ষা পায়। চাটমোহরের অসুস্থ কুকুরগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে এবং এগুলো রোগ ব্যাধি ছড়াচ্ছে। কুকুর নিধন সমর্থন যোগ্য না হওয়ায় এ কুকুরগুলো চাটমোহরের মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুকুরের দলবদ্ধ আক্রমণে সম্প্রতি চাটমোহর কাজীপাড়া মহল্লার একটি পোলট্রি খামারে কয়েক শতাধিক মুরগির মৃত্যু হয়েছে।
চাটমোহরে কর্মরত ভেটেরেনারী সার্জন পোল্ট্রি এন্ড ডেইরী বিশেষজ্ঞ ডাঃ রোকনুজ্জামান জানান, কুকুর প্রভুভক্ত। এটি আমাদের বাড়ি পাহাড়া দেয়। বাড়ির ময়লা আবর্জনা খেয়ে পরিবেশকে ভালো রাখে। প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় কুকুরের ভূমিকা রয়েছ। পাশাপাশি জলাতঙ্ক রোগ বাহী কুকুরের কামড়ে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ, গরু ও ছাগলের মৃত্যু হচ্ছে। অনেক হিং¯্র কুকুর ছোট ছোট ছাগলের বাচ্চাও খেয়ে ফেলছে। কুকুর ক্যানাইন ডিসটেম্পার নামক ভাইরাল রোগ বহন করে। কুকুরের মাধ্যমে চর্মরোগ মানুষে সংক্রমিত হতে পারে। কুকুর নিধন সমর্থন যোগ্য কিনা এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “প্রতিটি জীবের বাঁচার অধিকার আছে। কুকুর অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। জলাতংক রোগবাহী কুকুর ব্যতীত গৃহপালিত ও বেওয়ারিশ অন্য কুকুর অসুস্থ হলে বা সুস্থ কুকুর নিধন সমর্থনযোগ্য নয়। সমাজের বৃহত্তের স্বার্থে জলাতঙ্ক রোগবাহী কুকুর নিধন করা উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। বেওয়ারিশ কুকুরের তেমন জাত না থাকলেও গৃহ পালিত জার্মান শেফার্ড, ডোভারম্যানসহ বিভিন্ন প্রজাতির কুকুর মানুষ পালন করে থাকে। এগুলো অনেক চড়া দামে বিক্রিও হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে কুকুরের চিকিৎসালয় হচ্ছে। এটি বিস্তৃত হলে অধিক সংখ্যক কুকুর চিকিৎসার আওতায় আসবে। কুকুর বিড়াল বা অন্য কোন প্রাণী অসুস্থ হলে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রাণীর চিকিৎসা দিতে মালিকদের চাটমোহর প্রাণী সম্পদ অফিসে নিয়ে আসার আহবান জানান।
ডগ স্কোয়াড শব্দ দুটির সাথে সচেতন মানুষ মাত্রই পরিচিত। উন্নত দেশের মত আমাদের দেশেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি গুরত্বপূর্ণ অভিযানে প্রশিক্ষিত কুকুর অংশ নিয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। বিভিন্ন সময়োপযোগি চ্যালেঞ্জিং প্রশিক্ষণ দিয়ে আচরণের পরিবর্তন করে বোমা, মাদকদ্রব্য সনাক্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কুকুরকে।
জীব চিকিৎসা নীতিবিদ্যা নামে শুরু হওয়া প্রয়োগিক নীতিবিদ্যার একটি ভাগ জীব নীতিবিদ্যায় জীবন কেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। এখানে সামাজিক, আইনগত ও অর্থনৈতিক সমস্যা নামক তিনটি দিকের কথা উল্লেখ করা হয়। মানুষের বেলায় এগুলো প্রযোজ্য। বুদ্ধি বৃত্তি সম্পন্ন না হলেও জীববৃত্তির অধিকারী কুকুরসহ অন্যান্য জীব ও সমাজ জীবনের উপর প্রভাব ফেলছে। অন্যান্য জীবের মতো কুকুরের ক্ষেত্রেও দেহকে আশ্রয় করে থাকে প্রাণ। এ প্রাণশক্তির বলে কুকুরের দেহে শক্তি উৎপন্ন হয়, জৈবিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়, বংশবৃদ্ধি হয়, খাদ্য গ্রহণ করে, দেহের মধ্যে তাপ সঞ্চার হয়। তাই এ প্রাণ সত্তার অধিকারী কুকুরগুলো যখন বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় ধুকে ধুকে মরছে তখন এটি ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। জীবসত্তা রক্ষায় প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের ভূমিকা রাখা উচিত।