কলমাকান্দার কৃষকরা এখন বৈচিত্র্যময় দেশীয় ধান চাষ করছেন
কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
কৃষি প্রধান এ দেশে শতকরা প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ মানুষ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। মজার ব্যাপার হলো, মানুষ ও গবাদিপশু-পাখি সবারই খাদ্যের যোগান আসে এ কৃষি থেকেই । আদিকাল থেকে কৃষির অন্যতম প্রধান ফসল হিসেবে চাষ হয়ে আসছে ধান। গ্রাম বাংলার মানুষের প্রধান খাদ্য তালিকায় থাকে ভাত। যদিওবা শহরাঞ্চলে এখন ভাতের বিকল্প অনেক খাদ্যের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু এখনো গ্রামাঞ্চলে ভাতের কোন বিকল্প খাদ্য চর্চা গড়ে ওঠেনি। গ্রামীণ মানুষ তাই ধান উৎপাদনকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে সর্বাগ্রে। একসময় বৈচিত্র্যময় ধানের চাষ হলেও বর্তমানে তা অনেক হ্রাস পেয়েছে। অধিকাংশ ধান এখন আর চোখে পড়ে না। খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধির পাশপাশি এখন উন্নত বা অধিক ফলনের ধানজাত পছন্দের তালিকায় থাকে কৃষকের। আধুনিক কৃষির আবির্ভাবের পর থেকেই আদি ধানজাতগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ অনেক কৃষক আছেন যারা এখনো আদি ধানজাত খুঁজে বেড়ান বিভিন্ন স্থানে। তবে আমন মৌসুমে এখনো কিছু আদি বা স্থানীয় ধান জাত চাষ করতে দেখা যায়।
বিলুপ্ত প্রায় স্থানীয় ধানজাত সংগ্রহ, সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বর্ধনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বারসিক। বিভিন্ন কর্মএলাকায় ধানজাত প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে কৃষকদের স্থানীয় ধানজাত প্রদর্শন ও সংরক্ষণ ও বর্ধনের চেষ্টা করা হচ্ছে। একটি এলাকার মাটি, পানি, আবহাওয়া, পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে অভিযোজন করে কোন ধানজাতটি ফলন বেশি হয়, কোনটা আগাম হয়, কোনটা রোগবালাই কম বা পোকার আক্রমণ কম হয়, কোনটা সহজে নূয়ে পড়ে না, কোনটা খরা সহনশীল, কোন খার মাটি ও পানি সহনশীল, কোনটা বালিমাটি সহনশীল, কোনটা জলাবদ্ধ স্থানের ধান প্রভৃতি। এরই ধারাবাহিকতায় কলমাকান্দা উপজেলায় ২০১২ সালে বারসিক’র উদ্যোগে প্রথমবারের মত কৃষক নেতৃত্বে ধান জাত গবেষণার প্রদর্শনী প্লট করা হয়। ৮ শতাংশ জমিতে ২০টি ধানজাত দিয়ে গবেষণা প্লটটি করা হয়। যেখানে স্থানীয় কৃষকদের জ্ঞান, দক্ষতা ও চর্চাকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের পদ্ধতিতে ও তাদের নেতৃত্বে গবেষণা প্লটটি করা হয়। রোপণকৃত ধানজাত গবেষণা প্লটের মাঠ দিবসে কৃষকেরা তাদের পছন্দমত ধানজাত বাছাই করেন। পরের মৌসুমে বর্ধনের জন্য কয়েকজন কৃষক তাদের বাছাইকরা ধান রোপণ করে ভালো ফলন পান।
স্থানীয় ধানজাতের মধ্যে যেগুলো ফলন ভালো, পোকা আক্রমণ কম, নুয়ে পড়ে না এমন কিছু ধান জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছেন এই গবেষণা প্লটের মাধ্যমে। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কলমাকান্দা উপজেলার কৃষকেরা ধানজাত গবেষণা প্লট থেকে বৈচিত্র্যময় ধানজাতের বীজ সংগ্রহ করে চাষ করে যাচ্ছেন। যেসব ধানজাত এখনো কৃষকেরা প্রতিবছর চাষ করছেন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলে- মালশিরা, খেকশিয়াল, কার্তিকশাইল, সোনালী পাইজাম, বিশালী বিন্নি, পিপড়ার চোখ, জব্বার, চিনিগুড়া, গন্ধরাজ, রহমত, সাগরফণা, পুরাবিন্নি, মৌ বিন্নি, কাবুনদোলান। আদিবাসী পরিবারে বিশালী বিন্নি, মৌ বিন্নি, পুরা বিন্নি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
উল্লিখিত ধানজাতের মধ্যে মালশিরা অন্যতম। যেমন রংছাতি, খারনৈ, লেঙ্গুরা ও নাজিরপুর ইউনিয়নে ব্যাপক আকারে আমন মৌসুমে মালশিরা ধান চাষ করা হচ্ছে। ৫ বছর যাবৎ মালশিরা ধান চাষ করছেন কৃষক মথি ঘাগ্রা। তবে মাঝখানে এক বছর মালশিরা ধান চাষ বাদ দিয়েছিলেন। কিন্তু মালশিরা ধান চাষ করে যে পরিমাণ ধান পেয়েছিলেন অন্য ধান চাষে সে পরিমাণে ধান না পাওয়ায় পরের বছর আবারও মালশিরা ধান চাষ করে যাচ্ছেন। এ ধান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ ধানে পোকার আক্রমণ কম হয়, নিড়ানী না দিলেও সমস্যা হয় না, ধানের ওজন বেশি, উৎপাদন খরচ কম কিন্তু ফলন অন্যান্য ধানের চেয়ে বেশি। আমন মৌসুমে অন্যান্য ধান যেখানে ৮ শতাংশে ফলন হয় সর্বোচ্চ ২.৫ মণ সেখানে মালশিরা ধান হয় ৪ মণ।’ খারনৈ ইউনিয়নের আসাদ মিয়া ৩ বছর যাবৎ মালশিরা চাষ করছেন। তিনি বলেন, ‘এ ধান ফলনে অনেক ভালো, পোকা কম ধরে, সহজে নূয়ে পড়ে না, আমার জমিতে ফলন দেখে প্রতিবছরই আশপাশের গ্রামের কৃষকেরা আমার কাছ থেকে এ ধানের বীজ নিয়ে যাচ্ছে।’ গোবিন্দপুর গ্রামের এলিয় ¤্রং বলেন, ‘বারসিক’র কাছ থেকে ৫ কেজি মালশিরা ধানের বীজ নিয়ে আমাদের গ্রামে আমিই প্রথম রোপণ করি ২০১৮ সালে। এখন আমার গ্রাম ও পাশের খারনৈ গ্রামের অনেক কৃষক এখন এ ধান চাষ করছেন। প্রথম যে বছর আমি এ মালশিরা ধান চাষ করি। সে বছর আমি ৮ মণ ধান পাই। কিন্তু সেখান থেকে একমণও আমি খেতে পারি নাই। সব ধানই আমাকে বীজের জন্য আশপাশের কৃষকদের দিয়ে দিতে হয়েছে।’ পরিমল রেমা ২ বছর ধরে মালশিরা ধান চাষ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি অন্যের জমি আদি/ভাগি করি, আগে ১২ কাঠা (৯৬ শতাংশ) জামিতে পাইজাম ধান চাষ করে ভাগে পেতাম ১৪/১৫ মণ। এখন মালশিরা ধান চাষ করছি ২ বছর যাবৎ গত বছর ১২ কাঠা জমিতে ভাগে পেয়েছি ২১ মণ করে।’ আব্দুল হেলিম ৩ কাঠা জমিতে মালশিরা ধানচাষ করে ১৪ মণ ধান পেয়েছেন। আব্দুল হেলিম বলেন, ‘মালশিরা ধান ফলন ভালো হয়, ধানের মধ্যে চিতা কম হয়, পোকা কম ধরে। যে কোন জমিতেই ভালো হয়।’
সলিতা চিসিম ৩ বছর ধরে বিশালী বিন্নি চাষ করছেন। তার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেন, ‘বিশালী বিন্নি ফলনে অন্যান্য বিন্নি ধানের চেয়ে অনেক ভালো, খেতেও সুস্বাদু, এ ধানের চাল দিয়ে খই, পিঠা তৈরী করে খাওয়া যায়। ফলন বেশি হওয়ায় আমার কাছ অনেকেই বীজ নিয়ে গিয়ে চাষ করছেন।’ উজ্জ্বল হাজং এ বছর প্রথমবারে মত খেকশিয়াল ধান রোপণ করেছিলেন। যে জমিতে তিনি খেকশিয়াল ধান রোপণ করেন সে জমি ছিল বীজতলা। ধানের চারা উঠানোর পর ১০ শতক জমিতে এ ধান চাষ করে তিনি ৫ মণ ধান পেয়েছেন। এ ধানের ফলন দেখে ৪ জন কৃষক তার কাছে বীজ নিয়ে গেছেন আগামী আমন মৌসুমে রোপন করার জন্য। আগামী আমন মৌসুমে আরো বেশি জমিতে এ ধান চাষ করবেন বলে জানান উজ্জ্বল হাজং।
কৃষক নেতৃত্বে ধানজাত গবেষণা প্লটের মাধ্যমে যেসব ধানজাত এখন কৃষকেরা পছন্দ করে রোপণ করছেন। যেসব ধানজাত প্রতিবছরই বর্ধিত হচ্ছে কলমাকান্দার সীমান্ত এলাকায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে পাশাপাশি খাবারের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে কৃষকেরা এখন যেসব ধান ফলন বেশি হয় সেটিই পছন্দ করছেন ও রোপণ করছেন। বারসিক’র উদ্যোগে ও কৃষক নেতৃত্বে ধানজাত গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে কলমাকান্দা উপজেলায় ধান বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে যা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ বছর কলমাকান্দা কৃষি অফিসের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা তার নিজ উদ্যোগে পরীক্ষামূলক মালশিরা ধান বোরো মৌসুমে চাষ করেছেন। যদি ফলন ভালো পাওয়া যায় তবে পরবর্তীতে বেশি আকারে চাষ হবে বলে তিনি জনান।