ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঢাল

সাতক্ষীরা থেকে শাহীন ইসলাম

পরশপেপূল। লবণ সহনশীল একটি উদ্ভিদ। দেখতে অনেকটা ঝাকালো আকৃতির। গাছটি সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ ফুট লম্বা হয়। বছরে একবার পৌষ মাসে ফুল ফোটে। ফুল দেখতে মাইকের মত এবং হলুদ ও হালকা লাল রঙের হয়। ফুল থেকে ফল হয়। বটের মত থোকা থোকা ফল ধরে। ফাল্গুন চৈত্র মাসে ফল পাকা শুরু করে ও বৈশাখ মাসের মধ্যে সব ফল ঝরে পড়ে যায়। ফল দেখতে গোলাকৃতির ও ফলের গাঁয়ে ঢেউ খেলানো ৩টি স্তর থাকে। ফল কাঁচা বেলায় সবুজ, পাকলে বাদামি রঙ ধারণ করে। ফলের দৈর্ঘ্য ১২.৫ সে:মি: ও প্রস্থ ২.৫ সি:মি:। একটি ফলের ২০/২৫টি বীজ থাকে। পাকা ফল মাটিতে পড়লে, সেখান থেকে গাছ বের হয়। আবার ফল থেকে বীজ বের করে মাটিতে পুঁতে দিলেও গাছ বের হয়। সবুজ ও পান পাতার মত দেখতে। পাতার দৈর্ঘ্য ১৬.৫ সে:মি: ও প্রস্থ ৯.৫ সে:মি:। দুই বছরের মধ্যে একটি গাছে ফুল ও ফল ধরে। ১৫/২০ বছরের মধ্যে গাছ পরিপক্ক হয়। পরশপেপুল গাছের কাঠ অনেক শক্ত ও দামী।  ঘরের আসবাবপত্র তৈরীতে এর কাঠ খুব উপযোগী। এই গাছের তৈরী আসবাবপত্রে ঘুন ধরে না।
1
দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝূঁকিপূর্ণ উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পদ্মপুকুর গ্রামের নূর ইসলাম সানা বলেন,“আজ থেকে ১৮/২০ বছর আগের কথা। সাতক্ষীরার বিনেরপোতায় বড় ছেলের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে যাই। বিয়ার বাড়িতে ৫/৬টি বড় বড় গাছ দেখি। পেশায় রাজমিস্ত্রি বলে গাছের গুড়ি খুব ভালো এবং কাঠ শক্ত মনে হয়। থোকায় থোকায় ফল হয়।” তিনি বলেন, “বাড়ি আসার সময় কয়েকটি ফল নিয়ে আসি। বর্ষাকালে বীজ পুঁতে দেয়। কিছুদিন পর গাছ বের হয়। বাড়ির চারিধারের সীমানাজুড়ে পরশপেপুল গাছ লাগিয়ে দেয়। বাড়িতে পরশপেপুল গাছের নার্সারি করি। পরশপেপুল গাছ মারাত্মক নোনা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সহ্য করে টিকে থাকতে পারে।” তিনি জানান, আইলায় তাঁর বাড়ি সম্পর্ণূ ভেঙে যেতে পারিনি। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হলেও পরশপেপুল গাছে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের গতি কমে যায়। সে কারণে আমাদের মত দুর্যোগ প্রবণ এলাকার প্রতিটি বাড়ির চারিধারে পরশপেপুল গাছ লাগালে দুর্যোগের ক্ষতি কমানো সম্ভব।

আইলায় পর প্রায় একবছর নোনা পানির জোয়ার ভাটায় ইসলাম সানাদের বসতভিটা প্লাবিত হয়। এর ফলে, বসতভিটার আম, তাল, শিশুফুল, বাবলা, নারিকেল, ছবেদা, পেয়ারা, কুল, কলা, ডালিম, জাম, বকুল, লেবু, ডেগো, কৃষ্ণচূড়া, মেহগনি, খৈ, চাম্বুল, খেজুর প্রভূতি ফলজ ও বনজ গাছ নোনার কারণে মরে যায়। তবে, সকল গাছ মরে গেলেও পরশপেপুল গাছের কোন ক্ষতি হয়নি। আইলার পর থেকে মানুষকে বাড়ির চারিধারে পরশপেপুল গাছ লাগানোর পরামর্শ দের ইসলাম সানা। নার্সারি থেকে অল্প মূল্যে গাছ বিক্রি করেন তিনি। এছাড়া গাছের ফল ফ্রি বিতরণ করি। তিনি বলেন, “আমার নার্সারিতে প্রায় দু’হাজার পরশপেপুল গাছের চারা আছে। বীজ রোপণ করতে হয়। জ্যেষ্ঠ মাসে ফলের বীজ করে ৫/৬ হাত পর পর রোপণ করে ঢেকে দিতে হয়। অনেকটা কুচুরমূখি রোপণের মত। বর্ষার পানি পেয়ে সারি সারি চারা বের হয়। পরশপেপুল দূর্যোগ সহনশীল একটি উদ্ভিদ। আমি আজীবন পরশপেপুল গাছ সংরক্ষণ করব”। একই গ্রামের গৃহিনী মাফুরা বেগম বলেন, “পরশপেপুল গাছ আমার পরিবারের বড় বন্ধু। আমার ৮ সদস্যের পরিবারের সারাবছর জ্বালানি চাহিদা পূরণ করে। এ গাছের ফল ও পাতা জ্বালানি চাহিদা পূরণ করে।”
2
আইলার পর এলাকার সব গাছপালা মরে যায়। এলাকায় জ্বালানির খুব সংকট দেখা দেয়। কেউ চাল ধার দিয়ে জ্বালানি কাঠ ও পানি ধার দিত না। প্রায় জ্বালানি কিনে রান্না করতে হতো। এক মণ জ্বালানির দাম ১৫০ টাকা। এক মণ কাঠে ৪/৫ দিন রান্না করা যায়। তবে যারা পরশপেপুল গাছ লাগিয়েছেন বা যাদের বাড়িতে এ গাছ রয়েছে তাদের জ্বালানি সমস্যা হয়নি সেই সময়  বলে জানান মাফুরা বেগম। তাঁরা ঘরে পরশপেপুলের ফল ও পাতা বস্তায় ভরে রেখেছিলেন। এক বস্তা পরশপেপুল গাছের ফল দিয়ে ৬/৭ দিন ভালোমত রান্না করা যায়। ফল জ্বালালে আগুন গন গন করে। এই গাছের জ্বালানি দিয়ে দীর্ঘসময় রান্না করা যায় বলে তিনি জানান।

পরশপেপুল গাছের ঔষধি গুণও রয়েছে। সন্তান সম্ভাবনা নারীদের পানরোগ হয়। পানরোগ হলে ঘন ঘন পানি পিপাসা লাগে। হাত-পা ফুলে যায়। পরশপেপুল গাছের ফলের ছাল তিন বার ৪/৫ দিন পানের সাথে খেলে পানি পিপাসা দূর হয় এবং হাত-পা ফোলা কমে যায় বলে ইসলাম সানা ও মাফুরারা জানান।

তাঁরা গ্রামের নারীদের জ্বালানির কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য পরশপেপুল গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। মাফুরা বেগমের মতো বর্তমানে গ্রামের অনেকে বর্ষকালে জ্বালানির জন্য পরশপেপুল গাছের ফল ও পাতা বস্তায় ভরে রাখেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং লবণ পানির আগ্রাসনে শ্যামনগরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের গাছপালা মরে যাচ্ছে। অতিরিক্ত লবণাক্ত পরিবেশে বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছ বেঁচে থাকতে পারছে না। সেক্ষেত্রে, লবণ সহনশীল ফলজ ও বনজ গাছ লাগানোর পাশাপাশি ঝড়, জলোচ্ছ্বাস থেকে বসতবাড়ি রক্ষায় পরশপেপুল গাছের বনায়ন করে দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব।

happy wheels 2