কাঁশবন

হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন ও সত্যরঞ্জন সাহা

কাঁশবন ঝাউবন অনেক দেখেছি………..এমন অনেক গান আছে আমাদের মন মাতিয়ে দেয়। এই কাঁশ দেখলেই আমাদের মনে পড়ে যায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। আর এই স্নিগ্ধ, শুভ্র, কোমলতা মনোমুগ্ধতার জন্যই শরৎ ঋতুকে বলা হয় ঋতৃ রাণী। বাংলার প্রকৃতি ঋতু বৈচিত্রে বৈচিত্র্যময়। ঋতু বৈচিত্র্যের এ দেশের প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে ভিন্ন ভিন্ন সাজে। স্নিগ্ধ বাতাস আর নদীর পাশের খোলা জায়গায় ঘন কাশবনের সাদা ফুলের উঁকিঝুকি জানান দেয় শরৎকাল।
হরিরামপুরের রুপ প্রকৃতি আর সৌন্দর্য চোখে পড়ে পদ্মা নদীর তীরে জেগে উঠা চরগুলো। চরের যেদিকে চোখ যায় কেবল কাঁশবন আর কাঁশবন। কাঁশফুলগুলো বাতাসে দুলে ছেলে মেয়েরা খেলায় মেতে উঠে। সেই কাঁশবনই মনে করিয়ে দেয় শরৎকে। কাশবনের কাব্য আমাদের কবিতা আর সংস্কৃতির নানান স্থান দখল করে আছে।
nac-2016
শুধু কাব্য আর নান্দনিকতা নয় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাতেও কাঁশবন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। চরের কাইশ্যা, হোগলা, নলখাগড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ নদী ভাঙন ও মাটির ক্ষয়রোধে ভূমিকা রাখছে। অপরদিকে মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে কাইশ্যা, হোগলা, নলখাগড়া (ঘর তৈরিতে বেড়া, উপরের চালা, জ্বালানি, গো-খাদ্য, বসার পাটি তৈরির করে জীবন জীবিকার উন্নয়নে কাজ করছে। মানিকগঞ্জের মধ্য বয়রা গ্রামের দেলোয়ার হোসেন (৫২) বলেন,“ আন্দারমানিক, খালপাড় বয়রা, দড়িকান্দি, পাটগ্রামচর, খরিয়া, হালুয়াঘাটা এই গ্রামের প্রায় ১০০ জন নারী পুরুষ নদীর চর থেকে কাইশ্যা, হোগলা, নলখাগড়া আশ্বিন মাস থেকে অগ্রাহায়ণ মাস পর্যন্ত (তিন মাস) সংগ্রহ করে থাকে। নারীরা জ্বালানি সংগ্রহ, ঘরের বেড়া, পাটি, ঘরের ছাউনী কাজে ব্যবহার করে। সংগ্রহকৃত জ্বলানি রোদ্রে শুকিয়ে আঁটি বেধে ঘরে মাচার উপর রাখে। আষাঢ় থেকে ভাদ্র পর্যন্ত মাস বর্ষাকালে নারীরা রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে হোগলা, কাইশ্যা, নলখাগড়া ব্যবহার করে থাকে।”

প্রাকৃতিক দুর্যোগ নদী ভাঙন এবং মাটি ক্ষয়রোধে হোগলা, কাইশ্যা, নলখাগড়া পানির ঢেউ, স্রোতকে গতি রোধে বাধা সৃষ্টি করে। হোগলার গাছের শিকড় মাটির নিচে ৫/৬ হাত পর্যন্ত লম্বা হয়। ফলে মাটির খয় রোধে সহায়ক। স্থানীয় মানুষ নদীর তীরবর্তী এলাকায় বিশেষ করে এক বিঘা পর্যন্ত ছন, কাইশ্যা, হানা (কাইশা জাতীয়), খইগাছ, নলখাগড়া কাটে না। ফলে মাটি ধরে রাখতে ও নদী ভাঙন রোধে সহায়ত হয়। গবাদি পশুর খাদ্য নিরাপত্তায় চরের মাটিতে জেগে ওঠা কাইশ্যা, নলখাগড়া, গইচা, পাইনা, দুবলা, বাদলা, খরমা, কলমি ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকে। চরে প্রতিটি পরিবারে ৪/৫টি গরু জীবকায়নে সহযোগী। চরে প্রতিটি পরিবারে রয়েছে হোগলার ফুলের বালিশ, লেপ, তোষক এবং বিশেষ করে হোগলার পাতার পাটি দরিদ্র মানুষের চেয়ার হিসাবে কাজ করে। বাড়িতে অতিথি আসলে হোগলার পাটি দিয়ে বসতে দেওয়া হয়। হোগলার পাটি বিছানায়, জায়নামাজ, দস্তর খানাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে ।

প্রাণবৈচিত্র্য’র দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই কাঁশবনে, শিয়াল, বেজী, সাপ, গুইসাপ, ইদুর, খাটাস, কীট পতঙ্গ বিভিন্ন ধরনের ভাত শালিক, গুশালিক, চড়ই, বাবই, কানা কুড়হা, পাখি বাস করে। পশু পাখির নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। পদ্মা নদী ও কাঁশবন থেকে তারা খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। চরে পতিত জায়গা জন্ম নেওয়া হোগলা, কাইশ্যা, নলখাগড়া, ছোন মানুষের জীবন জীবিকার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। মৌলিক চাহিদা পূরণে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখছে। কাঁশবন প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও খাদ্যের উৎস হিসেবে শুধু সহায়কই নয় বরং আমাদের সংস্কৃতির একটি বড় উপাদান। তাইতো কবি নির্মলেন্দু গুণ তার কাশবনের কাব্যে লিখেছেন,

কিন্তু কবে ফুটেছে কাশ
কেউ পারেনা বলতে
সবাই কেবল থমকে দাঁড়ায়
গায়ের পথে চলতে………….

ইচ্ছে করে ডেকে বলি ওগো কাশের মেয়ে
আজকে আমার চোখ জোড়ালে তোমার দেখা পেয়ে।
তোমার হাতে বন্দি আমার ভালোবাসার কাশ
তাইতো আমি এই শরৎ এ তোমার কৃতদাশ।”

happy wheels 2