কৃষক-কৃষাণীর স্থানীয় জ্ঞানে কালাসোনা চরে কাঁচা মরিচ সংরক্ষণ
::গাইবান্ধা থেকে অমৃত কুমার সরকার ::
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের কালাসোনা চর মরিচ উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। প্রতিবছর এখানকার কৃষকরা বিপুল পরিমাণ মরিচ উৎপাদন করেন। এলাকার স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই মরিচ দেশের বিভিন্ন জায়গার প্রয়োজন মেটায়। কালাসোনা চরের কৃষকরা সাধারণত কার্তিক মাসে মরিচের বীজ বপন করেন আর বীজ বপনের ৬০-৭০ দিন পর থেকে মরিচ সংগ্রহ শুরু হয় চলে একবারে বৈশাখ মাস পর্যন্ত। অন্যান্য চরের মতো কালাসোনাও ভাঙন ও প্রাকৃতিক দূর্যোগপ্রবণ। তাই এখানকার মানুষ প্রতিকূলতার মধ্যেও বেঁচে থাকতে দূর্যোগপূর্ব, দূর্যোগকালীন ও দূর্যোগোত্তর বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। এলাকায় উৎপাদিত কৃষিজপণ্য মরিচ সংরক্ষণে চরের কৃষকের স্থানীয় জ্ঞান বন্যা ও অন্যান্য দূর্যোগকালীন সময়ে চরবাসীর খরচ কমিয়ে কাঁচা মরিচের গন্ধ, ঝাঁঝ, স্বাদ ও প্রয়োজন মেটায়।
কাঁচা মরিচ সিদ্ধ করে সংরক্ষণ
কালাসোনা চরে চৈত্র-বৈশাখ মাসে পর্যাপ্ত সরবরাহের জন্য এলাকার বাজারে কাঁচা মরিচের দাম অত্যন্ত কম থাকে। আবার এই সময়ের প্রচন্ড রৌদ্রতাপে মরিচ শুকানোর কাজটি খুব সহজ হয় বলে সিদ্ধ মরিচ সহজে পচে না। কাঁচা মরিচ সিদ্ধ করে সংরক্ষণ করতে হলে জমি থেকে সংগ্রহ করে বোঁটাগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ভালো করে ধুয়ে একটি পাতিলে এক কেজি মরিচের সাথে ১ পোয়া পরিমাণ পানি নিয়ে ১০-১৫ মিনিট ফুটাতে হয়। তবে ফুটানোর সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন পানির বাষ্প বেরিয়ে না যায়। সাধারণত ১০-১৫মিনিট ফুটালেই সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে যাবে। চুলা থেকে মরিচের পাত্র নামিয়ে ঠান্ডা করে সিদ্ধ মরিচগুলো পরিষ্কার কাপড়, টিন বা পাটির ওপর বিছিয়ে রোদে শুকানো হয়। এই ভাবে ৫-৬ বার রোদ দিয়ে খুব ভালোভাবে মরিচগুলো শুকিয়ে কাঁচের বা প্লাস্টিকে বয়ামে বায়ুরোধী করে সংরক্ষণ করতে হয়। এই ভাবে সংরক্ষিত মরিচ ৩ মাস পর পুনরায় রোদে দিলে পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত থাকে বলে চরের কৃষক-কৃষাণীরা জানান।
কাঁচা মরিচ ভেজে সংরক্ষণ
কাঁচা মরিচ ভেজে সংরক্ষণ করতে হলে কাঁচা মরিচের বোটা ছাড়িয়ে কড়াই বা ধাতব পাত্রে তেল বা পানি ছাড়াই ৫-১০ মিনিট ভেজে ৫-৬ বার রোদ দিয়ে ভালো করে শুকাতে হয়। ভালোভাবে শুকানোর পর মরিচগুলো ঠান্ডা করে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হয়। এই পদ্ধতিতে মরিচ সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে এক বছর পর্যন্ত এর গুণাগুন অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব। কাঁচা মরিচ সংরক্ষণ বিষয়ে কালাসোনার কৃষানী মোছাঃ জরিনা বেগম বলেন, “বর্ষার শুরুতে যখন আমাদের চরে কাঁচা মরিচের দাম খুব বেশি থাকে বা বাজারেও অনেক সময় বেশি দাম দিয়েও পাওয়া যায় না, ঠিক সে সময় থেকে নতুন মরিচ না আসা পর্যন্ত আমরা এই মরিচগুলো রান্নায় ব্যবহার করে থাকি। ফলে আমাদের বেশি দামে বাজার থেকে কাঁচা মরিচ কিনতে হয় না। কালাসোনার আর এক কৃষাণী মোছাঃ সাহানাজ বেগম জানান, বর্ষার সময়ও আমাদের সংসারে কাঁচা মরিচ কিনতে হয় না বলে সেই টাকা আমরা সংসারের অন্য কজে ব্যয় করতে পারি আর একই সাথে তাজা কাঁচা মরিচের স্বাদ, গন্ধ ও ঝাঁঝ পাওয়া যায়।
রান্নায় সংরক্ষিত মরিচের ব্যবহার
স্থানীয় চরবাসীরা তাদের সংরক্ষিত মরিচ সাধারণত বর্ষার শুরুতে যখন জমিতে মরিচ থাকে না বা বাজারেও মরিচের দাম বেশি থাকে ঠিক সে সময় ব্যবহার করেন। সংরক্ষণকৃত মরিচ ৫-৬ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রেখে শিল পাটায় মিহি করে বেঁটে তরকারিতে মেশানো হয়। এই বিশেষভাবে সংরক্ষিত মরিচ দিয়ে তরকারি রান্না করলে তাতে কাঁচা মরিচের অবিকল স্বাদ পাওয়া যায় বলে স্থানীয় চরবাসীরা জানান। আবার এই মরিচ ২-৫ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রেখে তারপর কেটে ভাজি করার কাজেও ব্যবহার করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কালাসোনায় কৃষাণীরা সংরক্ষণকৃত মরিচ ঢেঁকিতে পিষে রান্নায় ব্যবহার করেন।
মরিচ সংরক্ষণের এই বিশেষ কৌশলগুলো সময়ের পরিক্রমায় কালাসোনা চরবাসীদের মধ্যে ব্যপক প্রসার লাভ করেছে। পাশাপাশি সংরক্ষিত এই মরিচের বাজারজাত করার সুবন্দোবস্ত থাকলে তা আর্থিকভাবে এলাকার মানুষের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক হতো বলে চরবাসীর অভিমত। কাঁচা মরিচ সংরক্ষণে কালাসোনার কৃষক-কৃষাণীর নিজস্ব জ্ঞানে উদ্ভাবিত এই সহজ কৌশলটির প্রসার হলে দূর্যোগপ্রবণ গ্রাম-বাংলার অনেক দরিদ্র কৃষক উপকৃত হবেন।