সাম্প্রতিক পোস্ট

একজন মানিক মিয়ার গল্প

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

মানুষ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসবে এটাই আমাদের সমাজের চিরচেনা রূপ। নিজে ভালো থাকার পাশাপাশি অন্যদের ভালো রাখার মানুষ এ সমাজে নেহাৎ কম নয়। প্রতিটি মানুষের মাঝে নিজস্বতা বলে কিছু থাকে। থাকে শত কষ্ট করে হলেও মানুষের, সমাজের জন্য ভালো কিছু করার। তেমনই একজন মানুষ হলেন লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের আতকাপাড়া গ্রামের মো. মানিক মিয়া। তিনি পেশায় একজন পল্লী চিকিৎসক, বিভিন্ন রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। স্থানীয় বাজারে ছোট্ট একটি ঘরে তাঁর চেম্বার। সেখানে বসেই তিনি রোগী দেখেন। যে সবরোগী তাঁর চেম্বারে আসতে পারেন না, তাদের চিকিৎসা দিতে তিনি ছুটে যান বাড়িতে। একটি সাইকেলে চেপে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি এবং এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে তিনি ছুটে বেড়ান।
মানিক ডাক্তার, মানিক ভাই এই নামে তিনি এলাকায় পরিচিত। শুধু ডাক্তারি পেশাতেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেননি। চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি তিনি স্থানীয় একটি কেজি স্কুলে শিক্ষকতাও করেন। জড়িত আছেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও। ২০১১ সালে নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন গ্রামের সংস্কৃতিমনা মানুষদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বন্ধন সাংস্কৃতিক সংঘ’। এর সদস্য সংখ্যা ১৬ জন। এই সংঘের মাধ্যমে প্রতিবছর বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্যাপনসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করেন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান। যেমন বিষয়ভিত্তিক রচনা প্রতিযোগিতা, শ্রুতিপঠন, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এই সংঘের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রথমবারের মতো ২০১৬ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অভিনয় তাঁর নেশা। এলাকার যাত্রাশিল্পিদের মধ্যে তিনি সুপরিচিত। সুস্থ ধারা ও ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত বিভিন্ন যাত্রা পালায় তিনি অভিনয় করেন। প্রতিবছর শীত মৌসুমের প্রতিটি দিন তিনি ব্যস্ততার সাথে অতিবাহিত করেন। কোনো না কোনো জায়গায় যাত্রা পালা থাকবেই। আর সেখানে তিনি অভিনেতা হিসেবে, যে কোনো রূপে আবির্ভূত হন। এই অভিনয়ের সুবাদে বেশ কয়েকবার ঢাকাস্থ শিল্পকলা একাডেমিতেও যেতে হয়েছে তাঁকে। সেখানেও অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করেছেন।
তিনি যুক্ত আছেন স্থানীয় প্রশাসনের স্যানিটেশন, পানি সরবরাহ ও পয়োঃনিষ্কাশন বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটিতে। এছাড়া সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) এর জেলা পর্যায়ের একজন সদস্য হিসেবেও তিনি কাজ করেন।
২০১৮ সালের শেষের দিকে নেত্রকোনা জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘের আয়োজনে, লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ ও বারসিক’র সহযোগিতায় দিনব্যাপি ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ক্যাম্পে তিনি ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোগীদের মাঝে ঔষধ বিতরণের কাজ করেন। সেই থেকে তাঁর বারসিক’র সাথে যুক্ততা।
২০১৯ এর প্রথম দিকে লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষের সমন্বয়ে গঠন করেন শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি। উক্ত কমিটিতে শিক্ষক, ব্যবসায়ী, কৃষাণী, সাংস্কৃতিক কর্মী, কাঠমিস্ত্রি, রবিদাস, শিক্ষার্থী, প্রবীণ ব্যক্তি সকলেই যুক্ত আছেন। এই কমিটির আহবায়ক হিসেবে প্রতি মাসের প্রথম মঙ্গলবার তিনি মাসিক সভার আয়োজন করেন। উক্ত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত চলতি মাসেই বাস্তবায়ন করেন। এই কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়িত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে আছে পিঠা উৎসব, সচেতনতামূলক বিলবোর্ড স্থাপন, ইউনিয়নের গণশহীদদের নামের তালিকা প্রকাশ ও স্থাপন, বাজার পরিচ্ছন্নতা অভিযান ইত্যাদি। এছাড়াও প্রতি মাসের সভায় নেত্রকোণা অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ধারাবাহিক আলোচনাও হয়ে থাকে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে যারা সংগীত শিল্পি তারা গান পরিবেশন করেন। এভাবেই চলছে এই কমিটির কার্যক্রম।
বর্তমান সময়ে অর্থাৎ করোনা সংকট পরিস্থিতিতে মো. মানিক মিয়া পেশাগত কারণে অনেক রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের ত্রাণ সহযোগিতা কর্মকান্ডে তাঁর নেতৃত্বে শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সদস্যরা সার্বিক সহযোগিতা করছে। এক্ষেত্রে ওয়ার্ডভিত্তিক দরিদ্র ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি, ত্রাণ বিতরণে সহযোগিতা ইত্যাদি।
ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা থেকে নিজ গ্রাম আতকাপাড়াতে কৃষকদের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন কৃষাণ পাঠাগার। তাঁদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ, সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর পাঠাগারের পক্ষ থেকে গ্রামের মসজিদে হাত ধোয়ার সাবান দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। গ্রামের ভলান্টিয়ার টীমের কাজেও সহযোগিতা করতে তিনিই প্রথম এগিয়ে আসেন। লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের দোকান মালিক ও ক্রেতাদের করোনা মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কেও পরামর্শ দিয়েছেন। তাছাড়া বাজার স্থানান্তরের কাজে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহোদয়কে উদ্বুদ্ধ করতে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
একজন মানুষ কত দিক থেকে অন্যদের সহযোগিতা করতে পারেন তার উজ্জল দৃষ্টান্ত হলো মো. মানিক মিয়া। যে, যখন তাঁর সহযোগিতা চাইবেন তিনি সেভাবেই তাদের কাছে ছুটে যান। নিঃস্বার্থভাবে অন্যের উপকারে এগিয়ে আসেন। শুধু রোগিদের চিকিৎসা সেবা দেয়া নয়, অনেকেই শহরে ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন না। তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি চলে যান কখনো নেত্রকোনা কখনো বা ময়মনসিংহে। এমনও অনেক দিন যায় যেদিন তিনি বাড়িতে যাওয়ার মতো সময় পান না। সারাদিন মানুষের উপকারেই লেগে থাকেন।
আমাদের দেশে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা মানুষের জন্য, মানবতার জন্য কাজ করে। তারা আসলে কতটুকু, কি কাজ করে সেটি আমরা ফলাও করে প্রচার হতে দেখি। কিন্তু মানিক মিয়ার মতো সাধারণ মানুষেরা রয়ে যায় লোক চক্ষুর অন্তরালে।

happy wheels 2