সাম্প্রতিক পোস্ট

অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ নারীদের অবদান আজও উপেক্ষিত

মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক

অর্থনৈতিক কাজে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৫ ই অক্টোবর পালিত হয় “আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস”। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কৃষিকাজসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে নারীদের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও তাদের সেই কাজকে স্বীকৃতি আর মর্যাদার পরিপূর্ণ আসনে দেওয়া হয় না। “আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস” কি? এ সম্পর্কে অর্ধেকেরও বেশি গ্রামীণ নারীরা জানেন না। এ দিবস নিয়ে প্রচারণাও খুব একটা নেই কর্তৃপক্ষের। গ্রামীণ নারীদের কথা একটাই-সূর্য ওঠার আগ থেকে মাঝরাত অবধি কাজ করতে হবে। সন্তান-সংসার সামলাতে হবে। একদিন কাজ না করলে পরিবার নিয়ে দুবেলা দুমুঠো মুখে দিতে হিমশিম খেতে হবে।
“নারী” মানব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একথা অনস্বীকার্য্য যে, বর্তমান সভ্যতার অস্তিত্বের ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীর অবদান বিশাল। সভ্যতা ও উন্নয়নের প্রতিটি ধাপে নারী তার অবস্থান থেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সভ্যতার যত উন্নতি হচ্ছে নারীর অংশগ্রহণ ততই বাড়ছে। একসময় ঘরের বাইরের কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ তেমন ছিল না। এটাকে সমাজও ভালো চোখে দেখত না। কিন্তু আজ সমাজ ব্যবস্থা আর মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামীণ নারীর অবদান চোখে পড়ার মতো। এ দেশের পারিবারিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার পিছনে মূল অবদান গ্রামীণ নারীর। গ্রামের নারীরা অনেক কষ্ট করে, শত ত্যাগ স্বীকার করেও পারিবারিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখেন। প্রতিটি পরিবারের সুশৃঙ্খল গাঁথুনীর পিছনে মূল ভূমিকা নারীরই।

পৃথিবীর দেশগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেই দেশ তত বেশি উন্নত যে দেশের নারীরা যত বেশি সচেতন এবং কর্মঠ। আমাদের দেশেও নিজেদের যোগ্যতা ও মেধার বলে নারীরা স্থান করে নিয়েছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। অর্থনীতিকে সামনে এনে দেখিয়ে দিয়েছে কি করে জনসংখ্যার বিরাট অংশ তাদের শ্রমের উপর নির্ভর করে টিকে আছে। তারপরও শহুরে নারীরা কিছু সুযোগ-সুবিধার দেখা পেলেও গ্রামীণ নারীরা সেগুলো থেকেও বঞ্চিত। এ কারণে গ্রামীণ নারীর অবদানকে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দান এবং তাদের ভিতর আরও উদ্দীপনা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস পালন করা হয়ে থাকে।

১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের চতুর্থ নারী সম্মেলনে ১৫ই অক্টোবরকে বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব হলেও ১৯৯৭ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডে ওয়ার্ল্ড উইমেন সামিট ফাউন্ডেশন (িিংভ) দিবসটি পালনের জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করে আসছে। কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য দুরীকরণের ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকার প্রতি স্বীকৃতি স্বরূপ সাধারণ পরিষদ তার রেজুলেশন নম্বর ৬২/১৩৬-এর মাধ্যমে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নভেম্বর ২০০৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে ১৫ই অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেই থেকে জাতিসংঘ ভূক্ত সকল সদস্য রাষ্ট্র সমূহ এখন থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এ দিবস পালন করছে। গ্রামীণ নারী দিবস এর প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে উপস্থাপনের জন্য মঙ্গোলীয়ান প্রতিনিধিকে এবং চীন, ঘানা, গুয়েতিমালা, মেক্সিকো, পানামা এবং প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়া রিপাবলিক অব মেসিডোনিয়াকে সমর্থন দেয়।

manikgonj-1

দেশে নারী দিবস শত বছর পার করলেও, এখনও শ্রমের স্বীকৃতি মেলেনি গ্রামীণ নারীদের। ঘরে বাইরে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। সংসারে তো বটেই বাইরে পরিশ্রম করেও, নারী বলে হতে হচ্ছে অবমূল্যায়িত। সারাদিন হারভাঙা পরিশ্রম করেও, নায্য মজুরি বঞ্চিত হচ্ছেন, গ্রামীণ নারী কৃষি শ্রমিকরা। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় তিন সন্তানকে রেখে স্বামী মারা যাওয়ার পর মানিকগঞ্জের বরংগাইল গ্রামের রোকেয়া বেগম দু’বেলার খাবার জোটাতে নাম লেখান মহিলা শ্রমিকদের দলে। এর পর থেকে মাটি কাটা, ইট ভাটার তপ্ত দহনে, কৃষি কাজসহ সব ধরনের কায়িক পরিশ্রম শুরু করেন তিনি। কিন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও নারী বলে পুরুষের সমান মজুরি পান না তিনি। শুধু রোকেয়া বেগম নয়, তার মতো দেশের সব নারী শ্রমিকের অবস্থা একই। দিন রাত পরিশ্রম করেও, নায্য মজুরি পায় না।

পারভীন আক্তার বাস করেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার পাচুটিয়া গ্রামে। কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে উঠান ঝাড়ু ও থালা-বাসন ধোয়ার কাজ দিয়েই শুরু হয় তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের রুটিননামচা। রান্না-বান্না থেকে ঘরের কাজ, সব সদস্যের খাবার পরিবেশন, কাপড়-চোপড় ধোয়া, হাঁস-মুরগিকে খাবার দেওয়া, ছোট ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর প্রস্তুতি। আবার দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি। এরপরও কৃষিকাজেও সহায়তা করেন পরিবারের পুরুষদের সাথে। একান্নবর্তী পরিবার, সদস্য সংখ্যা বেশি তাই খাওয়া-দাওয়া চলে বিকেল পর্যন্ত। খাওয়ার পর থালা-বাসন পরিষ্কার করা, পাতিল মাজার কাজ করতে হয়। কখন যে বেলা গড়িয়ে যায়, টের পান না পারভীন। এরপর চলে রাতের খাবার তৈরির পালা। রাতে সবার খাওয়া শেষ হলে তার খাওয়ার পালা। অনেক দিন তরকারীও জোটে না কপালে। ঘুমোতে ঘুমোতে রাতের অনেক পেরিয়ে যায়। এভাবেই দিন কেটে যায় পারভীন আক্তারের। তারপরও স্বামী, ছেলেমেয়ে ও সংসার নিয়ে সুখে আছেন তিনি। শুধু একজন পারভীন আক্তারই নয়, আমাদের দেশের প্রায় সব গ্রামীণ নারীই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কঠোর পরিশ্রম করেন। কিন্তু নারীর এ কাজের স্বীকৃতি নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের নারীরা জনসংখ্যার অর্ধেক কিন্তু সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পুরুষের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে।

05

নারীরা আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে হাঁস, মুরগিসহ পশু পালন করে চেষ্টা করেন তাদের জীবন ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য। বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদনসহ আবাদি জমিতে ফসল ফলিয়ে স্বাবলম্বী হতে আগ্রহী গ্রামীণ নারী। শহরের তুলনায় গ্রামীণ নারী উন্নতির সোপানে পৌঁছাতে কঠোর পরিশ্রম করেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাড়ির উঠানসহ বাড়ির চারদিকে কোথাও পতিত জমি খালি রাখেন না। নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী সারাদিন পরিশ্রম করে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াচ্ছেন, পাশাপাশি সংসার উন্নতির জন্য আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছেন স্বামীকে। মানব সভ্যতায় কৃষির সূচনা ও বিকাশ ঘটেছে নারীর হাত ধরেই।

কর্মজীবী নারীর হিসাব মতে, কৃষি খাতের ২০টি কাজের মধ্যে ১৭টি কাজে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও; কৃষিতে নারীর স্বীকৃত নেই। বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল উত্পাদন, সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে গ্রামীণ নারীর সিংহভাগ অংশগ্রহণ থাকলেও কৃষক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন হয় না। কৃষিঋণ ও কৃষকের জন্য দেয়া সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলো থেকেও গ্রামীণ নারীরা বঞ্চিত। ‘গ্রামীণ জীবনযাত্রায় স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচার অভিযান’ এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের মোট নারী শ্রম শক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৬২ লাখ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী। যার ৬৮ শতাংশ কৃষি কাজে, পোলট্রি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কৃষি খাতে নিয়োজিত পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি। এছাড়া কর্মক্ষম নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত আছে ‘কৃষি কাজে’। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস)-এর গবেষণায় বলা হয়েছে গ্রামীণ ৪১ শতাংশ নারী আলু চাষের সঙ্গে জড়িত। ৪৮ শতাংশ মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত।

বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা বারসিক এর কর্মকর্তা শুকুফে ইসলাম বলেন, “দেশের বিশ্বখ্যাতি অর্জনের পেছনে আজকের গ্রামীণ নারীর ব্যাপক অর্জন থাকলেও তা স্বীকার করা হয় না। শুধু কৃষক হিসেবে নন; গার্মেন্টস সেক্টরে নারীকর্মী, প্রবাসে নারীকর্মী দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। নারীর এসব অর্জন কেবল সাম্প্রতিক কালেই নয়; আবহমান কাল ধরে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। অথচ এই নারীরাই মজুরি বৈষম্য ও কাজের স্বীকৃতি না পাওয়ার বঞ্চনার শিকার।”

গ্রামীণ নারীকে নিয়ে কাজ করা নাহিদা জেনী নামে এক নারী নেত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, “রোদ-বৃষ্টি, ঝড়ে প্রতিদিন ১০/১২ ঘণ্টা মাটিকাটা, পাথর ভাঙার মতো কঠিন কাজ করলেও মজুরি পান পুরুষের অর্ধেক। এসব শ্রমিক সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ করে দুপুরে খাবার সময় পান মাত্র এক ঘণ্টা। অধিকাংশ নারী শ্রমিকের কাজের জন্য কোনো সুষ্ঠু পরিবেশও নেই। তাদের জন্য নেই পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা। এমনকি নারী শ্রমিকের ছোট সন্তানের জন্য নেই মাতৃদুগ্ধ পানের বা ডে-কেয়ার সেন্টারেরও কোনো ব্যবস্থা। কৃষিকাজ ও অন্যান্য কাজে নিয়োজিত নারীর দাবি, নারীকে শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করে কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এতে তারা কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ ও কৃষি কার্ডসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করতে পারবে।”
অশিক্ষা আর সচেতনতার অভাবের কারণেই গ্রামীন নারীরা সব ক্ষেত্রে অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করেন নারী সংগঠনগুলো। তাই শিক্ষার পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদের সচেতনা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে আরো উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ তাদের। সৃষ্টির সহজাত ধারায় নারী-পুরুষের মধ্যে মর্যাদাগত কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু তারপরও নারীকে বঞ্চিত করেছে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে। তার ওপর চালিয়েছে অত্যাচারের খড়্গ। ছিনিয়ে নিয়েছে তার স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা। বাংলাদেশের বারো হাত শাড়ির আঁচলে জড়ানো নারীরা এখনও বেশি অবহেলিত। শিক্ষা-দীক্ষা ও নৈতিকতার বীজ বপিত হয় গ্রামীণ নারীর হাতে। জাতীয় পর্যায়ে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন তাদের শিকড় কোনো না কোনো গ্রামে। আর সেই শিকড় গড়ে উঠেছে কোনো মমতাময়ী নারীর যতœশীল ছোঁয়ায়। কখনও মা হিসেবে, কখনও বউ হিসেবে, আবার কখনও বোন হিসেবে নারীই সমাজের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।

লেখায় ব্যবহৃত ছবিগুলো সংগৃহীত

happy wheels 2