সাম্প্রতিক পোস্ট

খাদ্য সার্বভৌমত্ব

বারসিক ঢাকা থেকে এবিএম তৌহিদুল আলম

আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্য যেমন আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, রোগব্যধি থেকে রক্ষা করে। অন্যদিকে খাদ্য আমাদের নিজস্ব জীবনযাপন পদ্ধতি এবং সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। মানুষ নিজের প্রয়োজনে কৃষি কাজের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন শুরু করে আর সভ্যতার শুরুও সেখান থেকেই। সভ্যতার সাথে ক্রমান্বয়ে স্বতস্ফূর্ত ও সমান্তরালভাবে এগিয়েছে কৃষি। তাই আমরা দেখতে পাই কৃষি উৎপাদনের সাথে মানুষের মূল্যবোধ ও একটি দর্শনও জড়িয়ে রয়েছে। মানুষ শুধু নিজের জন্যই উৎপাদন করে না। সে তার জনগোষ্ঠীর জন্যও খাদ্য উৎপাদন করে। উৎপাদিত খাদ্য গ্রহণ করে মানুষ যেমন নিজে বেঁচে থাকে আবার অপরাপর প্রাণিকূলকেও বাঁচিয়ে রাখে। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায়, খাদ্য উৎপাদনের সাথে মুনাফার কোনো সম্পর্ক নেই বরং এখানে জড়িত রয়েছে এক গভীর মুল্যবোধের প্রশ্ন। এ মুল্যবোধই তাকে মানুষ হিসাবে আলাদা চিহ্নিত করে দেয়। এভাবেই মানুষ একই সাথে তার নিজের খাদ্য উৎপাদন করে এবং অন্যান্য প্রাণিরও খাদ্য নিশ্চিত করে।

Slide1

খাদ্য সার্বভৌমত্ব একটি ব্যাপক ধারণা যা প্রান্তিক কৃষকের নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন ও খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াকে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে রাখার অধিকারকে নির্দেশ করে। মালি’র সেলিঙ্গা (Selingue) নামক স্থানে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ তারিখে বিশ্বের ৮০ টি দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রায় ৫০০ প্রতিনিধির অংশগ্রহণে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে খাদ্য সার্বভৌমত্বের বৈশ্বিক আন্দোলনকে বেগমান করার জন্য এই ধারণাটির সুসংহতকরণ ও কৌশলগত কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়। সেলিঙ্গা (Selingue) নামক স্থানের নাইলিনি (Nyeleni) গ্রামে অনুষ্ঠিত নাইলিনি (Nyeleni) ঘোষণা-২০০৭ অনুযায়ী “খাদ্য সার্বভৌমত্ব হলো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মানুষের নিজস্ব কৃষি ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ খাদ্যের অধিকার, যে খাদ্য হবে পরিবেশসম্মত ও টেকসই উপায়ে উৎপাদিত। খাদ্য সার্বভৌমত্ব বাজার বা কোম্পানির স্বার্থ সিদ্ধি না করে বরং যারা খ্দ্যা উৎপাদন, বিতরণ এবং সেই খাদ্য যারা গ্রহণ করে তাদের স্বার্থকেই কেন্দ্রে রাখে। এটি বংশপরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মকে সংযুক্ত করে ভোক্তার স্বার্থ সমুন্নত রাখে। খাদ্য সার্বভৌমত্ব খাদ্যের উপর বিদ্যমান কর্পোরেট ট্রেড ও একক মুনাফাভিত্তিক ব্যবস্থা বিলুপ্তির বিকল্প কৌশল যার মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকের কৃষি উৎপাদন, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, পশুপালন ও মৎস্য চাষ ইত্যাদি বিষয় উৎসাহিত করা হয়।

খাদ্য সার্বভৌমত্ব স্থানীয় বাজার ও দেশের জাতীয় অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রান্তিক কৃষক ও তাদের পাারিবারিক কৃষিকাজ, ঐতিহ্যগত মৎস্যচাষ, পশুপালন, স্থানীয় জাতের শস্য-ফসল উৎপাদন, পরষ্পরের মধ্যে বিনিময়, বিতরণ ও গ্রহণে গুরুত্ব দেয় যা পরিবেশ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে টেকসই একটি প্রক্রিয়া। খাদ্য সার্বভৌম একটি অধিকার যেখানে উৎপাদক ও ভোক্তা সকলে সমানভাবে উপকৃত হয় ও খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় থাকে। এতে খাদ্যের উপর ভোক্তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উভয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু তাই নয়, খাদ্য সার্বভৌমত্বের মাধ্যমে ভূমির উপযুক্ত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা, পানি, বীজ, প্রাণিসম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা হয় যা খাদ্য উৎপাদনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। খাদ্য সার্বভৌমত্ব নারী-পুরুষ, বর্ণ ও সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য নিপীড়ন ও অসাম্যতা দূর করে পরষ্পরের মধ্যে নতুন এক সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে।

অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তা হলো খাদ্যের সহজলভ্যতার এমন একটি অবস্থা যা যখন সকল মানুষকে তার প্রয়োজনীয় চাহিদার সময়ে পর্যাপ্ত, নিরাপদ, পুষ্টিমান সম্পন্ন খাবারের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু খাদ্য উৎপাদনের নৈতিক বিষয়াদি যেমন কে, কোথায়, কোন উপায়ে খাদ্যশস্য্য উৎপাদন করছে এবং তা পরিবেশসম্মত কিনা সেইসব বিষয়গুলো যেমন বিবেচনায় আনে না তেমননি কিভাবে সেটি বিতরণ হচ্ছে সেটিও আমলে নেয় না। কিন্তু খাদ্য সার্বভৌমত্ব খাদ্য উৎপাদনের নৈতিকতা ধারণ করে তাই খাদ্য সার্বভৌমত্ব শুধু খাদ্য উৎপাদনই নয় এর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকৃতি-প্রতিবেশ পরিবেশ এবং অন্যান্য প্রাণি জগতের সম্পর্ককেও যুক্ত করে। আর এই সকল উপাদানের সাথে সম্পর্ক রেখেই খাদ্য উৎপাদন করে মানুষের সভ্যতা চলমান রয়েছে। খাদ্যে সার্বভৌমত্ব কৃষকের নিজ এলাকার পরিবেশ, সংস্কৃতি ও কৃষি পদ্ধতির সাথে সঙ্গতি রেখে উৎপাদন ও জনগণের খাদ্য পাবার অধিকারকে গুরুত্ব দেয়। এই অধিকারের মধ্যে নিরাপদ পুষ্টিসম্মত খাদ্য এবং নিজ সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত খাদ্যের কথাও আছে। খাদ্য সার্বভৌমত্বের অধিকার একই সাথে জমি, পানি, বীজ এবং সকল প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারকেও বুঝায়। কৃষিতে নারীর অবদান এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্পূর্ণ স্বীকৃতিও দেয়। অর্থাৎ নিজেদের খাদ্য, কৃষি, পশুপালন ব্যবস্থা, মৎস চাষ বা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে কৃষকের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ও অধিকারই হচ্ছে খাদ্য সার্বভৌমত্ব।

নাইলিনি (Nyeleni) ঘোষণা-২০০৭ অনুযায়ী খাদ্য সার্বভৌমত্বের ছয়টি মূল ভিত্তি হলো

ক. খাদ্য সর্বাগ্রে মানুষের জন্য: সংশ্লিষ্ট যে কোনো নীতিমালায় মানুষের জন্য খাদ্যের প্রয়োজনীয়তাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া এবং খাদ্যশস্যকে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের মতো ভোগ্যপণ্য(Commodity) হিসাবে বিবেচনা না করা।

খ.খাদ্য উৎপাদকের যথাযথ মূল্যায়ন করা: খাদ্য উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত প্রান্তিক কৃষকের শ্রম-ঘাম-মেধা-জ্ঞানের মূল্য দেওয়া এবং তাদের খাদ্য উৎপাদনের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া।

গ. চাহিদার ভিত্তিতে স্থানীয়ভাবে খাদ্য উৎপাদন করা: খাদ্য উৎপাদক ও খাদ্য গ্রহণকারী ভোক্তার মধ্যেকার দূরত্ব কমিয়ে স্থানীয় ভোক্তার জন্য স্থানীয় ভাবে খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া। এতে ভোক্তার উৎপাদিত খাদ্যের মান জানার সুযোগ তৈরি হয়। পাশাপাশি খাদ্য নিয়ে যে কোন প্রকার চুক্তি ও নীতিমালা যা কর্পোরেট বা অসাম্য বাণিজ্য তৈরি করে তা নিরুৎসাহিত করা।

ঘ. খাদ্য উৎপাদনে স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা: স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ জমি-জলা-প্রাণি-বীজ সম্পদের উপর অধিকার ও স্থায়িত্বশীল ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনে স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যাতে প্রান্তিক পর্যায়ের উৎপাদকরা নিজেদের মধ্যে বিনিময় ও বিতরণের মাধ্যমে স্থানীয় এলাকার বিরাজমান প্রাণসম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার ও সুরক্ষা করতে পারে।

চ. খাদ্য উৎপাদনে স্থানীয় জ্ঞান ও দক্ষতায় আস্থা রাখা: খাদ্য উৎপাদনে প্রান্তিক কৃষকের অভিজ্ঞতা ও স্থানীয় জ্ঞানের উপর আস্থা রেখে তার উপর গবেষণা ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই স্থানীয় জ্ঞান সঞ্চারিত করা। পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদনের স্থানিক প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিহীন প্রযুক্তি বর্জন করা।

ছ. পরিবেশসম্মত উপায়ে খাদ্য উৎপাদন করা: স্থানীয় কৃষিপ্রতিবেশ বিবেচনায় নিয়ে শক্তির অতিরিক্ত অপচয় রোধ, কৃষি রাসায়নিকের ব্যবহার না করা ও একক ফসল চাষ পরিহার করে পরিবেশ সম্মত উপায়ে বৈচিত্র্যময় খাদ্যশস্য উৎপাদন করা।

Slide2বিশ্বায়নের মাধ্যমে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি আজ খাদ্যবাণিজ্যেও ফায়দা লুটছে। তারা কৃষিরাসায়নিক, বীজ ও খাদ্যশস্যের ব্যপারে কৌশল নির্ধারণ করে একচেটিয়া ব্যবসায়িক প্রভাব বিস্তার করছে। এতে ক্ষতিকর কৃষি রাসায়নিকের ব্যবহার ও বিক্রি বাড়ছে এবং স্থানীয়কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা গুরুত্ব হারাচ্ছে। কৃষিশিল্পের প্রসারের সাথে সাথে এবং রপ্তানিমুখী শস্য উৎপাদনের ফলে অধিকতর কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে কৃষক-শ্রমিক-ভোক্তা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং আমাদের খাদ্য, জমি, বাতাস ও পরিবেশও হচ্ছে বিষাক্ত। এই বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর জেনেটিক প্রকৌশলে উদ্ভাবিত অনুজীব, বীজ ও খাদ্য জনস্বাস্থ্য প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে। আমাদের কাছে জমি হচ্ছে খাদ্য, জীবন যাত্রা ও সংস্কৃতির উৎস। বর্তমানে কর্পোরেট পুঁজি ব্যবস্থাপনায় কৃষি একটি শিল্প কারখানায় পরিণত হয়েছে। কৃষি আজ বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাই খাদ্য সার্বভৌমত্ব মৌলিক অধিকার হিসাবে বহু আন্তর্জাতিক সনদে স্বীকৃত হলেও বিশ্বের বহু দেশ এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের পঞ্চাশ কোটি লোক কৃষক ও সরাসরি উৎপাদক হিসাবে কাজ করেও পুষ্টিহীনতার শিকার যা মূলত প্রান্তিক কৃষক ও গরিব মানুষের জমির উপর অধিকারহীনতা, ত্রুটি যুক্ত খাদ্য সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনারই ফল।

খাদ্যের এ বিষাক্ত আগ্রাসন থেকে মুক্তির জন্য পৃথিবীর মানুষ আজ মুক্তির পথ খুঁজছে। বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট খাদ্য ব্যবস্থা প্রচলনের পর থেকেই খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রান্তিক কৃষক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠির খাদ্য সার্বভৌমত্ব হুমকির সন্মূখীন। অন্যদিকে কৃষকদের খাদ্য সার্বভৌমত্ব হুমকির সন্মূখীন হলে বিশ্বব্যাপী মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও বিপন্ন হবে। কারণ কৃষকরা যদি স্বাধীনভাবে খাদ্য উৎপাদন করতে না পারে, উৎপাদন উপকরণের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে। তাই মানবজাতির আগামী সভ্যতা বাঁচিয়ে রাখার জন্য খাদ্য সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

happy wheels 2