সাম্প্রতিক পোস্ট

মানিকগঞ্জে  নদী আছে; পানি নেই

মানিকগঞ্জে নদী আছে; পানি নেই

মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক

মানিকগঞ্জ জেলার আয়তন ১৩৭৯ বর্গকিলোমিটার। যার মধ্যে ছোট বড় মিলিয়ে এক ডজনের মতো নদ-নদী ছিল। এসব নদীর দৈর্ঘ্য ২৪১ কিলোমিটার। এত নদীর জেলা আর কোথাও আছে কিনা তা হিসাবের বিষয় বৈকি। নদীবেষ্টিত জেলা মানিকগঞ্জে নদ-নদীর সংখ্যাতত্বে আধিপত্য থাকলে বর্তমানে দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো নদী না ফসলি জমি।

এ সব নদীর মধ্যে পদ্মা এবং যমুনা নদীতে সারাবছর কোন রকমে পানি গড়ায়। কেবল বর্ষার তিনমাস নদী বলে মনে হয় কালীগঙ্গাকে। তারপর কালীগঙ্গায় কোন স্রোত থাকে না, ফসলের আবাদ হয়। ধলেশ্বরী নদী কেবল বর্ষা মওসুমে সরু খালের আকার নিয়ে মাস দুয়েকের জন্য জানান দেয় ধলেশ্বরী নামে কোন নদী ছিল এইখানে একদিন। তারপর সারাবছর তার বুকের উপরে চলে ধানচাষ, সব্জিবাগান। আর সমতল ভূমি হয়ে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গেছে ক্ষীরাই, কান্তাবতী, মনলোকহালি, ভুবনেশ্বর, ইছামতি, গাজীখালির মত আরও বেশ কটি নদী। টিকে আছে কেবল পুরানো মানচিত্র আর দলিল দস্তাবেজে।

Ghior-Manikgonj-1 (2)

পদ্মা ও যমুনার মতো বড় দু’টি নদী ছাড়াও মানিকগঞ্জের বুক চিড়ে প্রবহমান ছিল ইছামতী, কালীগঙ্গা, কান্তাবতী, মনলোকহানী, গাজীখালী, ক্ষীরাই, মন্দা, ভুবনেশ্বর ও ধলেশ্বরীর মতো ৯টি শাখা নদী। পানিবিহীন এসব নদ নদী এখন আস্তে আস্তে ঠেলে দিচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়ের পথে। উজানে ভারতের পানি প্রত্যাহার, ড্রেজিং না করা ও দখলের কারণে প্রায় ৬ টি নদী, ৪২টি খাল-বিল ও প্রায় দুই শতাধিক ছোট জলাশয়ের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একসময় যেখানে বছরজুড়ে পানি থাকত, শুকনো মওসুমে সেখানে এখন এক ফোঁটা পানিও মেলে না নৌকার পরিবর্তে চলাচল করে ঘোড়ার গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন। এ যেন পানির দেশে-পানির জন্য হাহাকার।

নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। কিন্তু নদী কেন্দ্রিক সেই ঐতিহ্য, জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, কৃষি, অর্থনীতি ক্রমশই হয়ে আসছে সংকোচিত। এ ধারা অব্যাহত থাকলে নদ নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে সেই সাথে পাল্টে যাবে নদীকেন্দ্রিক জীবন ও জীবিকা, সভ্যতা, সংস্কৃতি।

মানিকগঞ্জ সীমানায় এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। নতুন প্রজন্মের কাছে ধলেশ্বরী আর কালীগঙ্গা নদী আজ কেবলমাত্র কাগজে কলমে রয়েছে; বাস্তবে এই নদীর চিত্র এতটাই করুণ অবস্থা যে, বুঝার উপায় নেই যে, নদীর বুকে চর না কি চরের বুকে নদী? এমন প্রশ্নের উত্তর মেলা সত্যিই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কালীগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর বুকজুড়ে কেবলই বালু ভান্ডার। রীতিমত পরিণত হয়েছে সবুজ শস্য ক্ষেতে। এককালের বেগবান নদী বক্ষে গড়ে উঠেছে বিশাল চরাঞ্চল, শস্যশ্যামল প্রান্তর, লোকালয়, জনপদ, হাটবাজার, রাস্তাঘাট আর নদীর কূলে কূলে গড়ে উঠা ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত প্রাচীন শহর, বন্দর, বর্ধিষ্ণু জনপদ, পুরার্কীতির স্থাপত্যের অস্তিত্ব সবকিছু হারিয়ে গেছে প্রাণহীন ধলেশ্বরী আর কালগিঙ্গার বালুকা রাশিতে। এই নদীকে দখল, দূষণমুক্ত এবং রক্ষা করার প্রত্যয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মানিকগঞ্জ ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন ও বেসরকারী উন্নয়ন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকসহ সচেতন ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা দেশের প্রধান দুই নদী পদ্মা ও যমুনা ছাড়াও ধলেশ্বরী, পুরনো ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, ইছামতি নদী রয়েছে। ১৩৭৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মানিকগঞ্জে এসব নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪১ কিলোমিটার। কিন্তু নাব্যতা হারানো এসব নদীর আকার-আয়তন মারাতœকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে নদীর গতিসীমা।

Ghior-Manikgonj-1 (3)

তথ্য-উপাত্ত মারফত জানা যায়, পাশববর্তী জেলা টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায় যমুনা থেকে ধলেশ্বরী নদীর উৎপত্তি। সেখান থেকে এই নদী মানিকগঞ্জের ঘিওর ও সাটুরিয়া উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি সিংগাইর হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। এই নদীর মানিকগঞ্জের ৬০ কিলোমিটারের তিন-চতুর্থাশই আছে শুধু নামে। বর্ষা মওসুমে সময় নৌকা চলাচলের মতো পানিও থাকে না বাকি অংশের কিছু জায়গায়। ধলেশ্বরীর শাখা কান্তাবতী, মনলোকহানী, ক্ষীরাই, মন্দা ও ভুবনেশ্বর নদীর এখন আর অস্তিত্ব নেই।

নতুন প্রজন্ম এসব নদীর নাম বই-পুস্তক আর মুরুব্বীদের মুখে শুনেছে মাত্র, দেখার ভাগ্য হয়নি। ২৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পুরনো ধলেশ্বরী নদী দৌলতপুর উপজেলার মূল যমুনা থেকে শুরু হয়ে ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় এসে শেষ হয়। ধলেশ্বরীর আরেকটি শাখা নদী গাজীখালি একসময় স্রোতস্বীনি থাকলেও বর্তমানে কার্যত মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। মানিকগঞ্জ জেলায় সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর হয়ে গাজীখালী নদী দরগ্রাম, সাটুরিয়া, গাঙ্গুটিয়া, সুয়াপুর, রোয়াইল, ইউনিয়ন পাড় হয়ে ঢাকা জেলার সাভারের বংশী নদীতে পতিত হয়েছে। প্রায় ৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত এ নদী বছরের ৮-৯ মাসই পানি শূন্য থাকে। সেই সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে নদীটির বিশাল এলাকা। দখলকৃত জায়গায় কেউ বাড়িঘড় নির্মাণ করে আছে, কোথাও আবার দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, কেউ নিয়মিত চাষাবাদ করে নদীর অবশিষ্ট চিহ্নটুকু মুছে ফেলছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে গাজীখালী নদীর উৎসমুখে এক কিলোমিটার এলাকা খনন করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ শিডিউল অনুযায়ী কাজ হয়নি বিধায় তখনকার খননে মূলত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যমুনা নদীর ৪০ কিলোমিটার অংশ, মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার পশ্চিম সীমান্তঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে শিবালয় উপজেলায় পাটুরিয়া ঘাটে এসে শেষ হয়েছে। বর্ষা মওসুমে যে যমুনা নদী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে কেড়ে নিয়েছে সবকিছু, গৃহহারা করে দিয়েছে হাজারো মানুষকে। বর্তমানে সেই যমুনার বুকে জেগে উঠেছে বিশাল চর। মাঝ নদীতে বিশাল চর জেগে ওঠায় নদীর গতিপথে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যা যমুনা পাড়ের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অশনি সঙ্কেত। দৌলতপুরের কাছে যমুনা থেকে কালীগঙ্গা নদী উৎপন্ন হয়ে জাবরা কোল ঘেঁষে সিঙ্গাইরের ধল্লা পর্যস্ত এ নদীটির বিস্তৃতি। এর দৈর্ঘ্য ৪৫ কিলোমিটারের বেশি। বর্তমানে এই নদীর অধিকাংশ স্থানে শুকনো মওসুমে নৌকা চলার মতো পানিও থাকে না। কোথাও কোথাও একেবারেই শুকিয়ে গেছে। চলছে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ। গুমড়ি খেয়ে পড়েছে বালু ব্যবসায়ীরা। পদ্মার শাখা ইছামতী নদী হরিরামপুর উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফের পদ্মায় মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার। ভাঙন ঠেকাতে প্রায় ১৭ বছর আগে যাত্রাপুরের কাছে বাঁধ দেয়া হয়। বর্তমানে এটি মৃতপ্রায়। কেবল বর্ষা মওসুমে একটা সরু ধারা প্রবাহিত হয়।

প্রকৃতি-পরিবেশ-জলবায়ু বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বারসিক এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায় জানান, নদী ও খাল-বিলের পানি নেই; জেলেদের ভাগ্যে নেমে এসেছে সীমাহীন দারিদ্র্য। যাদের মূল পেশাই ছিল নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা, নদীতে পানি না থাকায় মাছ আহরণ করতে পারছে না তারা। ফলে পরিবার নিয়ে তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। সংসারের তাগিদে কেউ কেউ আবার বেছে নিয়েছে দিনমজুরের কাজ।

03 (1)

স্থানীয় জেলে পরীক্ষিত হালদার বলেন, “নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মাছ ধরা পড়ছে না। যেখানে প্রতিদিন কয়েকজন জেলে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মাছ ধরতো সেখানে হাজার টাকার মাছও মেলে না। এ অঞ্চলের অধিকাংশ গরিব চাষি আগে এসব নদী থেকে পানি তুলে জমিতে সেচ দিতেন। নদীগুলো মরে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এতে মারাত্মক সেচ সঙ্কটে পড়েছেন কৃষকরা। এর ফলে কৃষি মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি নদ-নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা।”

মানিকগঞ্জের পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন নেত্রী লক্ষ্মী চ্যাটার্জ্জী বলেন, “নদী মাতৃক বাংলাদেশে মানিকগঞ্জে নদীর প্রভাব ছিল বিস্তর। কিন্তু আজ পানির দেশে যেন পানির জন্যই হাহাকার। নদী কেন্দ্রিক জীবন জীবিকা অর্থনীতি প্রভৃতি সচল ও গতিশীল রাখার পাশাপাশি প্রকৃতি, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি এড়াতে প্রয়োজন সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনায় সরকারের মনোযোগ ও কার্যকরী পদক্ষেপে আরো গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।”

মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নদী পুনঃখনন না করায় মৎস্য উৎপাদন, কৃষি ও পরিবেশবান্ধব নৌকার ব্যবহার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ২০১১-১২ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গাজীখালী, যমুনা ও কালিগঙ্গার বালিরটেক এলাকায় নদীতে কিছু খননের কাজ হয়েছে। এ ছাড়া আরো খননের জন্য জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড বরাবর একটি প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে। মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মামুন উর রশিদ বলেন, “মানিকগঞ্জে প্রবহমান নদীগুলো মরে যাওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্রসহ সর্বত্র এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।”

happy wheels 2

Comments