বনের পাখিও সারাদিন বন বাঁদারে ঘুরে সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরে আমরা ফিরি না

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
কয়েক দিন আগের কথা। বাইশ বছর বয়সী যুবক সুন্দর তরণী দাস দুই সহযোগিসহ শুকরের পাল নিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন পাবনার চাটমোহর থেকে সিরাজগঞ্জের মান্নাননগরের দিকে। রাস্তায় চলার সময় শুকরগুলো নিয়ন্ত্রণ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছিল। দুদন্ড কথা বলার মতো সময়ও যেন নেই তাদের। একটা ঝোঁপ ঝাঁড় জাতীয় জায়গায় শুকরগুলো স্থির করে তার পাশে দাঁড়িয়ে জীবনে ছুটে চলার গল্প শোনান এ যুবক।

সুন্দর তরণী দাস বলেন, ‘সিরাজগঞ্জের সলঙ্গার ঘুরকা বেলতলা এলাকায় আমাদের বাড়ি। বাবা অনন্ত তরণী দাস অভাবী মানুষ ছিলেন। সংসার চালাতেই তাকে হিমশিম খেতে হতো। তাই স্কুলে যাবার সুযোগ হয়নি কখনো। নয় বছর বয়স থেকে মাঠে মাঠে রাস্তা ঘাটে শুকর চড়ানোর কাজ করে আসছি। বাবা নিজেও শুকর চড়াতেন। এখনো চড়ান। প্রথমে তার সাথে শুকর চড়ানোর কাজ শুরু করি। পরে পৃথক ভাবে কাজ শুরু করি।’

sokor pic-2

তিনি আরও বলেন, ‘পিতার আমল থেকে বংশানুক্রমে এ পেশার সাথে জড়িত আমরা। বছরের বারো মাসই চড়ায় পাথারে মাঠে ঘাটে পরে থাকতে হয় আমাদের। যেদিন যেখানে রাত হয় সেদিন সেখানেই তাবু গাড়ি। নিজেরাই রান্না বান্না করে খেয়ে তাবুতে রাত কাটাই। ঝড় বৃষ্টি হলে কষ্টের সীমা থাকে না। তাবুতে ভিজতে হয়। এক মাস বা দুই মাস পর পর বাড়ি যাই। সময় মতো নাওয়া খাওয়া হয় না কোন দিনই। দিনে রাস্তা ঘাটের পাশে শুকর চড়ানোর সময় হঠাৎ মানুষের জমিতে গেলে মানুষ বকে গাল পারে কিন্তু আমাদের কিছুই বলার থাকে না। সারা দিনে প্রায় আট দশ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়।’

sukor pic-1
সুন্দর তরণী দাস বলেন, ‘আমার দাদা শেরত তরণী দাসের চার ছেলে। ৬ শতাংশ জায়গার উপর তাদের সবার বাড়ি। গাদা গাদি করে বাড়িতে বসবাস করতে হয়। আমাদের সংসারে বাবা মা দুই বোন ও আমি এ পাঁচজন খানেওয়ালা। অপর এক বোনকে আগেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। সে এখন অন্যের সংসারে আছে। বোনেরা পড়া লেখা জানে না। সাংসারিক কাজ কর্ম করে। আমি মাসিক ৭ হাজার টাকা বেতন পাই। প্রতিদিন অন্তত চারশ’ টাকা সংসার খরচ। আমার আয় ও বাবার আয় দিয়ে কোন মতে চলে যায় ৫ সদস্যের সংসার। এটা ছিল ডোমদের ব্যবসা। আমার দাদা বা তার পূর্ব পুরুষেরা ঘাট মাঝি ছিলেন। খেয়া ঘাটে নৌকা চালাতেন। কাল ক্রমে অধিক রাস্তা ঘাট হয়ে যাওয়ায় খেয়া নৌকার আবেদন কমে আসায় আমরা এখন শুকর চড়ানোর কাজ করি। তাছাড়া কিছু নৌঘাট থাকলেও ধনী মানুষেরাই নৌকার ঘাট ইজারা নেয়। এর ফলে আমাদের মতো মানুষেরা এখন বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করছেন।’
শুকর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক একটা বড় শুকরের ওজন ১শ’ কেজি পর্যন্ত হয়। দশ বারোটা পর্যন্ত বাচ্চা দেয়। তিন মাস বয়সী প্রতিটি বাচ্চা শুকর প্রায় ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে শুকরের মাংস চলে বলে জানান তিনি।

sukor pic-4
সুন্দর তরণী দাস এর সহকর্মী নব তরনী দাস ও প্রহ্লাদ তরণী দাসের বাড়ি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গার সদরে। এদের সাথে আলাপকালেও বেরিয়ে আসে কষ্টকর জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। তারা বলেন, “বনের পাখিও সারা দিন বন বাঁদারে ঘুরে বেরিয়ে সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরে। আর আমরা সারা দিন রাস্তায় মাঠে ঘাটে কাটিয়ে রাতে তাবুর পাশে রক্ষিত শুকর গুলো পালাক্রমে পাহাড়া দেই। ঝড়, বৃষ্টির সময় নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। তারপরও ছুটে চলি এ মাঠ থেকে ও মাঠে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে আমাদের এ ছুটে চলা।’

happy wheels 2

Comments