চরের জীবন জীবিকা ও প্রাকৃতিক আইসোলেশন

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থেকে মুকতার হোসেন ও সত্যরঞ্জন সাহা:
ভৌগলিকভাবে চর এমন এটি জায়গা যা প্রাকৃতিকভাবেই মূলভূমি থেকে কিছুটা আইসোলেটেড বা বিচ্ছিন্ন। ফলে জাতীয় ও বৈশ্বিকভাবে আইসোলেশনের উপর যে বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে চরবাসীদের কাছে সেটা নতুন কিছু নয় বরং সারাবছরই তারা এ ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই জীবনযাপন করে। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার একটি বড় অংশের হাজার হাজার মানুষ বিগত ৩২ বছর ধরে বসবাস করে আসছে এমনই আইসোলেশনের নিয়মে। আজকের করোনা পরিস্থিতিতে আইসোলেশনে থাকার কারণে মানুষ যে বিষয়গুলোকে সমস্যা মনে করছে, এই ধরণের সমস্যা নিয়েই চরের মানুষকে জীবনযাপন করতে হয়। আমরা যেমন ইচ্ছাকৃতভাবে আইসোলেশনে যেতে চাই না, যেতে বাধ্য করা হয় চরবাসীও নানাধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগে সবকিছু হারিয়ে চরে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘদিন বসবাস করতে করতে এখন তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এখন চরই হয়ে উঠেছে তাদের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার স্বপ্নভূমি। চরে বসবাস করতে চরবাসীকে যেমন নানা ধরনের সমস্যা মোকবেলা করতে হয় তেমনি আবার নিজেদের শ্রম, মেধা আর চরের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছে জীবিকায়ণের বৈচিত্র্যতা ও সম্ভাবনা।

ছাগল ও ভেড়া চরের মানুষের জীবন জীবিকার অন্যতম উৎস

প্রতিবছর বন্যার কারণে জমিতে পলি পড়ে। চরের ধূ ধু বালি আস্তে আস্তে উর্বর জমিতে রূপ নেয়। সেই জমিকে নারী-পুরুষ উভয়ের শ্রমে সৃষ্টি হয় শস্যভূমি আর তাতে চাষ হয় করত রকমের বাহারি ফসল, শাক, সবজি। কৃষকের বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদনে বীজ সংরক্ষণ ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সফল হচ্ছে অনেক মানুষ। করোনাকালীন সময়ে চরে নারীরা বাড়ির কাজ, গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি মাঠ কৃষিতেও নারীদের অবদান সবচেয়ে বেশী। বর্তমানে ছেলে মেয়েরা বাড়িতে খেলা ধুলা ও বিকালে ঘুড়ি উড়ায়। নিজ বাড়িতে লেখাপড়া করতে দেখা যায়। চরের মানুষজন করোনায় ভয় নয়, কৃষি কাজের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা সর্বদায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। চারিদিকে যখন বৈশি^ক মহামারী করোনা ভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতিতে হরিরামপৃুর উপজেলার চরাঞ্চলের মানুষ তাদের এলাকার উৎপাদিত খাদ্যশষ্য দিয়ে তাদের জীবন অতিবাহিত করছে।
পদ্মার চরের মানুষ জন লকডাউনের কারণে বিশেষ ট্রলারে হরিরামপুর উপজেলায় আসতে পারে। বিশেষ ট্রলারটি আন্ধারমানিক ঘাট থেকে এক বার ছাড়ে আবার চরের হরিনা ঘাট থেকে চলে আসে। চরের কৃষকদের সমস্যা হলো ঝিটকা হাট, নয়ার হাট না বসায় কৃষি পণ্য হাটে খাদ্য শষ্য বিক্রয় করতে পারছে না আর এই সুযোগে স্থানীয় পাইকারগণ কম দামে ক্রয় করে ষ্টক করছে। ফলে চরের মানুষ ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চরের বসত বাড়িতে ও মাঠে শাক- সবজি তৈরি করে নিজেদের চাহিদা পুরণ করে বিক্রয় করেন। ফসল হিসাবে মাঠে আছে তিল, আউশ (পরাংগি ধান) পাট ইত্যদি। বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরার উপকরণ তৈরি করেন ধুয়ারী, নাবানি, চাই, পল, চাক জাল, ধর্ম জাল, খেয়া জাল ইত্যাদি। অর্থাৎ এই করোনা পরিস্থিতিতে চরের মানুষের কোন খাদ্য সংকট নেই বলা যায় কিন্তু নিজেদের তৈরি উৎপাদিত ফসল বিক্রি করারও নেই কোন সুযোগ ফলে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে খাদ্য শস্য, কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে।


চরের কৃষদের সবচেয়ে বড় সম্পদ গৃহপালিত প্রাণি। চরের প্রতিটি পরিবারে ১০ থেকে ৩০ টি গরু রয়েছে। তাছাড়া প্রায় ৬০ ভাগ বাড়িতে ছাগল-ভেড়ার ছোট খামার রয়েছে। বাড়িতে রয়েছে হাঁস-মুরগি, কবুতর পালন করেন। প্রাণি সম্পদ পালনে চরের নারীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। নারীরা মাঠ থেকে ঘাস সংগ্রহ, বাড়িতে প্রাণিদের পানি ও ঘাস খাওয়ানো এবং ঘরে তুলেন। প্রাণি সম্পদ পালনে চরের কৃষক যেমন যতœবান তেমনি ব্যস্ত সময় পার করেন। তবে এক্ষেত্রেও প্রধান সমস্যা হচ্ছে পণ্যের নায্যমূল্য। চরবাসী যেহেতু প্রচুর পরিমাণে দুধ উৎপাদন করে, তাই বাজারজাত না করতে পেরে অনেকেই ক্ষতিকগ্রস্থ হচ্ছেন। যদি চরে একটি সংরক্ষণাগার থাকতো তবে কৃষক ক্ষতি থেকে বেঁচে যেতো আর দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদাও পুরণ হতো। এই করোনা পরিস্থিতিতে যদি চরের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত করার জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে চরবাসীর জন্য এবং দেশবাসীর জন্য তা হতো খুবই কল্যাণকর।

happy wheels 2

Comments