সাম্প্রতিক পোস্ট

প্রজন্ম হোক সমতার

প্রজন্ম হোক সমতার

সিলভানুস লামিন
এক
বিশ্বব্যাপী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষেত্রে নানা বৈষম্য ও নির্যাতন রোধের জন্য নারীরা দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করে আসছেন। ১৯১০ সালের ৮ মার্চ জার্মান নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিন ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজবাদী সম্মেলনে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে উদ্যাপনের প্রস্তাব করেন। তার এই প্রস্তাবকে বিশ্বের ১৭টি দেশের একশ’ জন নারী সমর্থন করেন। কোপেনহেগেনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরবর্তী বছর তথা ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ অষ্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। মূলত শ্রম ঘণ্টা কমানো, কাজের শর্ত ও মজুরি বৃদ্ধির লক্ষ্যে নারী আন্দোলনের ব্যাপ্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক আন্দোলন ও প্রচার-প্রচারণার ফলে জাতিসংঘ ১৯৪৫ সালে নারী-পুরুষ সমতা ( Gender Equity ) মানবাধিকারের অন্যতম অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সানফ্রান্সিকো চুক্তি সই করে। সংস্থাটি ১৯৭৫ সালকে আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। মূলত এরপর থেকে ৮ মার্চ সারা বিশ্বে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বৃহত্তর পরিসরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপনের সূচনা হয়। কোন কোন দেশে ৮ মার্চ সরকারি ছুটি দেওয়া হয় যদিও আমাদের দেশে সেমিনার, সভাসহ নানান কর্মসূচি পালনের ভেতরে এটি সীমাবদ্ধ রয়েছে। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস একশত বছর পূর্তি পূর্ণ হলো। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ সেসব নারীদের কথা স্মরণ করা হয় যারা নারীদের অধিকার, সমমর্যাদা আদায়ের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে আত্মনিয়োগ করেছেন। আমাদের দেশেও অনেক নারী রয়েছেন যারা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছেন; অনেকের নাম আমরা কম বেশি জানি এবং তারা বিভিন্নভাবে স্বীকৃতিও পেয়েছেন আবার অনেকে রয়েছেন যারা নিভৃতে-নিরবে অবদান রেখেছেন, রেখে চলেছেন। তারা হয়তো কখনও জনসন্মূখে আসতে পারেননি প্রচারণার অভাবে কিংবা প্রচার-বিমূখ হওয়ার কারণে। আমরা নারী অধিকার ও নারী-পুরুষ সমতা আনায়নে আন্দোলন সূচনাকারী সেসব নারীদের ভূমিকার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। এ বছরের (২০২০) আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রজন্ম হোক সমতার: সকল নারীর অধিকার’। বিগত বছরগুলোতে নানান আকর্ষণীয় প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে কোনটিই সফলতার মুখ দেখেনি।

দুই
বর্তমান এই লেখাটিতে কেন সকল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত সেই যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া নারী-পুরুষকে কেন সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া এবং সমানভাবে মূল্যায়ন করা উচিত সেই বিষয়টিও লেখক নিজস্ব যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। নারীরা তাদের যোগ্যতা বলেই নানান প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানানভাবে অবদান রেখে চলেছেন। নারীরা কখনো খাদ্য উৎপাদক, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষক, প্রশাসক, ক্রীড়াবিদ, কখনো মমতায়ী জননী, শিক্ষক এবং কখনো ঝাণু রাজনীতিক, সমাজসেবক, লেখিকাসহ নানান পদ অলংকৃত করে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিনির্মাণে অবদান রেখে চলেছেন। আজ এমন কোন ক্ষেত্র খুজে পাওয়া যাবে না যেখানে নারীর বিচরণ পড়েনি; সবক্ষেত্রেই সফলতার সাথে নারীরা তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। আজ নারীর মধ্যে পাইলট আছেন, ক্রীড়াবিদ আছেন, সৈনিক আছেন, পুলিশ আছেন। পুরুষ যে কাজ করতে পারেন সেই কাজ নারীরাও যে করতে পারেন-এ ধারণটা আমরা অনেক সময় রাখি না। কারণ নারীকে আমরা দুর্বল বলে মনে করি! কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা নারীকে পুরুষের অধ্বস্তন মনে করি। মূলত পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ধারণ করার কারণে এমনটি ভাবি আমরা। আমাদের গৎবাঁধা চিন্তা ও মানসিকতার কারণেই সমাজে নারী ও পুরুষের সমতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে নারী ও পুরুষ তো সমানই! কিছু দৈহিক পার্থক্য ছাড়া আর কোন পার্থক্যই নেই। নারী ও পুরুষ উভয়ে মানুষ, উভয়ে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অনুভূতি, আশা-আকাঙ্খা আছে। তবে আমরা মানুষেরা তথা পুরুষেরা (ক্ষেত্রবিশেষে নারী নিজেও। কারণ কিছু কিছু নারী আছেন যারা নিজেদের আড়াল করেন, সামনে আসতে চান না, পুরুষকে সেবা করাই যেন তাদের জন্ম হয়েছে বলে মনে করেন। যদিও এটি পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থারই ফল) নানা বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করি। সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করলে নারীরা পুরুষের সমান অনেকগুলো কাজ করতে পারেন।

তিন
আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, স্পিকার একজন নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী একজন নারী। এছাড়া দেশের আনাচে কানাচে অনেক নারী জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে সফলতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকগুলো পদেও নারীরা রয়েছেন। কোর্ট কিংবা আদালতে বিচারপতি, ব্যারিস্টার, এডভোকেট হিসেবে নিজের দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতার সাথে পালন করেন। বলা চলে, দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে নারী নেতৃবৃন্দ নানানভাবে দেশের প্রশাসনিক কাজগুলো সফলতার সাথে পালন করেছেন। বাংলাদেশ এখন আর আগের সেই দরিদ্র বাংলাদেশ নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত থেকেও এগিয়ে। এ সফলতা কিন্তু পুরুষ এককের নয়; নারীর সঠিক নির্দেশনা, ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক দক্ষতার ফসলও এটি। আজ বাংলাদেশ দিনকে দিন উন্নতির দিকে ধাবিত হয়েছে। এই অগ্রগতি, প্রগতি বা উন্নয়ন যাই বলি না কেন এখানে নারীর সমান অংশীদারিত্ব আছে। তাই আমার মনে হয়, যে নারীরা এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে দেশের ও সমাজের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছেন তাদের জন্য সমসুযোগ-সমানাধিকার দাবি করা ঠিক তাদের অবদানের সাথে যায় না! আমি তো মনে করি, নারীদের জন্য পৃথক একটি দিবস রাখা, তাদের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার চাওয়া একটি অযৌক্তিক বিষয় এবং এতে নারীকে আরও পশ্চাদপদ করে তুলেছে। বরং সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসেবে নারীকে দেখা হলে এসব দাবি, অধিকার, বা সুযোগ-সুবিধা চাওয়া কোন মানে হয় না। কারণ নারী তো পুরুষ থেকে পিছিয়ে নয় জ্ঞানে,গুণে, চিন্তায় কিংবা কাজে! তাঁর জন্য আলাদা পরিবেশ, আলাদা দিবস, পৃথক ব্যবস্থার প্রয়োজনই পড়েনা যদি আমাদের সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন হয়। নারী ভোগপণ্য, অধ্বস্তন, কিংবা দুর্বল হিসেবে দেখা আমরা তো পরিবার থেকে শিখে আসছি, যে পরিবারের প্রধান কর্তা একজন পুরুষ! তবে বাস্তবতা যেহেতু এখনও নারীর প্রতিকূলে এবং যেহেতু আমাদের সমাজ কাঠামো পুরুষ দ্বারা শাসিত তাই সঙ্গত কারণেই নারীদের জন্য একটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করার এই দাবি উঠে আসে। এ দাবি কিন্তু করুণা করে নয়; বরং এটা নারীর প্রাপ্য। কারণ নারীরা তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা কারণেই আজ তাদের নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন।

চার
আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান কোন অংশে কম নয়। অনেক নারী আছেন যারা কোন কোন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা। তারা স্বীয় যোগ্যতা বলেই এমন পদ আসীন করেছেন। নারীরা কোথায় নেই? সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনেক নারী পুরুষের পাশাপাশি বা সমানতালে সফলতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করেন। মাঠে, ঘাটে গেলেও নারীর বিচরণ দেখা যায়। গার্মেন্টস-এ বেশির ভাগ কর্মীই নারী। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই আজ এই খাতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, ব্যবসা, উদ্যোক্তা হিসেবে যেমন নারীরা আজ পুরুষের সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তেমনি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই ঘরে বসে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। এছাড়া নারীরা যে গৃহস্থালি কাজ সম্পাদন করেন সেগুলোর অর্থনৈতিক মূল্য পরিমাপ করলে দেখা যাবে যে, দেশীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান পুরুষের তুলনায় অনেকক্ষেত্রে বেশি। একজন মা হিসেবে নারী যে দায়িত্ব পালন করেন সেটা কী আর্থিক মানদণ্ডে পরিমাপ করা সহজ? অবশ্যই না। জননী হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, ভাবী হিসেবে, দাদী হিসেবে, বোন হিসেবে নানানভাবে নারীরা তাদের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে আসছেন। একটি পরিবারের সম্পূর্ণ বিষয়ের দেখভাল করার দায়িত্ব কিন্তু নারীর ওপরই পড়ে। পরিবারকে সচল রাখার জন্য নারীকে তাই সন্তান লালন-পালন, রান্নাসহ নানান কাজের সাথে জড়িত থেকে আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা পালন করে। দেখা যায়, রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে পরিবারের ছোট্ট একটি কর্মসম্পাদনেও নারীর ভূমিকা রয়েছে এবং সবক্ষেত্রেই দায়িত্ব পালনে নারীরা তাদের দক্ষতা মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তাই আসুন আমরা পরিবর্তন হই, পরিবর্তন করি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার। নারীকে দেখি একজন মানুষ হিসেবে, একজন সৃষ্টিশীল মা, রাষ্ট্র প্রধান হিসবেে বোন, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, উকিল, পাইলট, পুলিশ হিসেবে এবং উৎপাদক, সংগঠক, ক্রিড়াবিদ কিংবা বিচাররক হিসেবে! তবেই না পরবর্তী প্রজন্ম সমতায় বিশ্বাসী হবে, সমতাকে আরাধনা করবে এবং সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাবে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পানে। তাই উচ্চারণ করি ‘প্রজন্ম হোক সমতার’।

happy wheels 2

Comments